চার নাগরচাঁদা

বাংলা ভুতের গল্প

এক গাঁয়ে ছিল এক সজ্জন যুবক। অল্প বয়সে তার বাবা মারা যান এবং মাও চলে যান। তার অন্য কোনো আত্মীয়-স্বজন ছিল না। তাদের ভালো বাড়ি ও কিছু জমি-জায়গা ছিল। পাশের গ্রামের এক গরিবের সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হলো। সুন্দরী বউ পেয়ে যুবক খুব খুশি।

যুবক মাঠে নিজের জমিতে খুব পরিশ্রম করত। জমিতে সব রকম ফসলই বেশ ভালো হতো। বছর দুই-তিন পর যুবক দেখল, তার সেই সুন্দরী বউ অন্য এক অবিবাহিত যুবকের সঙ্গে পিরিতে মজে গিয়েছে। এই দেখে সে মনে খুব আঘাত পেল। এরপর একদিন নিশিভোর রাতে বউ তাকে, ঘর-বাড়ি ছেড়ে কোথায় যেন বিবাগী হয়ে চলে গেল।

শোকে-দুঃখে যুবক পাগলের বেশে ঘুরে বেড়াতে লাগল।

একদিন একজন যুবক ডাক্তার তাকে দেখে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। তিনি বললেন, "আমার বাড়িতেই খাও-দাও, থাকো।" এই ডাক্তারের ছিল এক সুন্দরী যুবতী স্ত্রী। ডাক্তারের ডাক্তারি পেশায় যেমন পসার ছিল, তেমনি ছিল জমি-জমা। বাড়ির মধ্যে চার-পাঁচটি গোলায় ধান থাকত।

ডাক্তারের এই যুবতী স্ত্রী তাদের গ্রামের একজন যুবককে ভালোবাসতেন। সেই যুবককে গোপনে এনে একটি বড় ফাঁকা গোলার মধ্যে লুকিয়ে রাখতেন। ডাক্তার খাওয়া-দাওয়া সেরে বাড়ি থেকে চলে গেলে, তিনি খাবার নিয়ে গোলায় ঢুকে তার উপপতিকে খাওয়াতেন।

প্রতিদিনই গোলায় খাবার নিয়ে আসতে তার দেরি হতো, তাই মেয়েটির উপপতি প্রথমে তাকে দশ ঘা জুতো মারত, তারপর খেত। আশ্চর্যের বিষয়, এই জুতোর মার খেতে মেয়েটি ভালোবাসত।

একদিন ডাক্তারের এক বন্ধু ডাক্তারকে একটি গোলাপ ফুলের তোড়া উপহার দিলেন। ডাক্তার ফুলের তোড়া নিয়ে বাড়ি এসে তার স্ত্রীকে একটি ফুল ছুঁড়ে মারলেন। ফুলটি তার স্ত্রীর মুখে লাগতেই সে মূর্ছা যাওয়ার ভান করল।

এদিকে পাগলবেশী যুবকটি সবকিছু দেখছিল। ফুলের আঘাতে মেয়েটিকে মূর্ছা যেতে দেখে সে আপন মনে একটা গান গাইতে লাগল:

"মনের দুঃখ বলি কারে,

বিবির কাণ্ড দেখে হলাম পাগল।

পাগল হয়ে লাগালাম গোল,

ডাক্তারের সঙ্গে পথে হলো যোগাযোগ।

তার ঘরে এসে দেখি সেই একই রোগ,

চাক চাঁদার ভিতর থাকে নাগর চাঁদ।

বিবি গুনে দশ ঘা জুতো খায়,

বিবি ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যায়।"

ডাক্তার এবং উপস্থিত সকলে এই কথা শুনে কিছুই বুঝতে পারলেন না। ডাক্তার ডাক্তারি পরীক্ষা করলেন, কিন্তু কোনো রোগ পেলেন না। তখন ডাক্তার ভাবলেন, লোকটি সত্যিই পাগল হয়ে গেছে।

ছোট এক শহরে ডাক্তারের এক কবিরাজ বন্ধু ছিল। সে পাগলের চিকিৎসা করত। ডাক্তার লোকটিকে তার কাছে নিয়ে গেলেন। কবিরাজ সব দেখে শুনে বলল, "কিছুদিন আমার বাড়িতে থাকুক। আমি একে ভালো করে দেখব।"

পাগলবেশী লোকটি কবিরাজের বাড়িতেই খায়-দায় এবং থাকে। কবিরাজ বাড়ি থেকে তার ডাক্তারখানায় চলে গেলে, কবিরাজের স্ত্রী, কবিরাজের যে লোক ওষুধের বকলস আনে, তার সঙ্গে নটঘট করে। তাদের এই প্রেম দীর্ঘদিনের। পাগল সবকিছু দেখল এবং আবার গান ধরল:

"মনের দুঃখ বলি কারে,

বিবির কাণ্ড দেখে হলাম পাগল।

পাগল হয়ে লাগালাম গোল,

ডাক্তারের সঙ্গে পথে হলো যোগাযোগ।

তার ঘরে এসে দেখি একই যে রোগ,

চাক চাঁদার ভিতর নাগর চাঁদা।

বিবি গুনে দশ ঘা জুতো খায়,

বিবি ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যায়।

কবিরাজের নিকট নিয়ে গেল চিকিৎসার তরে,

ঐ একই রোগ দেখি কবিরাজের ঘরে।"

কবিরাজ সব শুনে কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি পাগলের অসুখ ধরতে পারলেন না। পাগল তখন এই গান গেয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে লাগল।

একদিন এক শিক্ষক পথ বেয়ে যাচ্ছিলেন। শিক্ষক সাধু প্রকৃতির লোক। পথে পথে গান গাওয়া পাগল লোকটিকে দেখে তার মায়া হলো। সে পাগলকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল।

সেখানে কিছুদিন থাকার পর লোকটি দেখল, শিক্ষকের সুন্দরী স্ত্রী, শিক্ষক যখন স্কুলে চলে যান, তখন বাড়ির চাকরের সঙ্গে নটঘট করছে। কয়েক দিন ধরে পাগল এসব দেখল। দেখে পাগল আবার পথে পথে গান গেয়ে বেড়াতে লাগল। পাগল গান গায়:

"মনের দুঃখ বলি কারে,

বিবির কাণ্ড দেখে হলাম পাগল।

পাগল হয়ে লাগালাম গোল।

ডাক্তারের সঙ্গে হলো পথে যোগাযোগ,

তার ঘরে এসে দেখি একই যে রোগ।

চাক চাঁদার ভিতর নাগর চাঁদা,

বিবি গুনে দশ ঘা জুতো খায়,

বিবি ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যায়।

কবিরাজের নিকট নিয়ে গেল চিকিৎসার তরে,

ঐ একই রোগ দেখি কবিরাজের ঘরে।

সেখান হতে এসে পথে পথে বেড়ায়,

পথে খায় পথেই ঘুমায়।

পথ বেয়ে যায় এক সাধুজন,

বলে—‘পাগলামি কর কি কারণ!

চল আমার ঘরে দিব ঠাঁই’,

ঐ একই রোগ তার ঘরে দেখতে পাই।"

এইভাবে গান গেয়ে গেয়ে পাগল পথে পথে ঘুরে বেড়াতে লাগল।

দেশের রাজা একদিন ভ্রমণকালে তাকে দেখতে পেলেন। তাকে দেখে রাজার খুব দয়া হলো, আর তাকে রাজবাড়িতে নিয়ে এলেন। পাগল রাজবাড়িতে সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়।

একদিন রাজা রাজদরবারে গিয়েছেন, আর রানি একটি বড় সিন্দুক হতে এক যুবককে বার করে তাকে স্নান করিয়ে ভালো ভালো খাবার খাওয়াচ্ছেন, আর সেই খাবারের অবশিষ্ট রেখে দিচ্ছেন। এরপর রানি তাকে আবার বড় সিন্দুকে ভরে দিলেন।

রাজা যখন রানির নিকট ফিরে এলেন, রানি তখন সেই উচ্ছিষ্ট খাবার রাজাকে খেতে দিলেন। রাজা কিছু জানেন না, তাই খেলেন। পাগল সব দেখল। এই যুবকটির সঙ্গে রানি বিবাহের আগেই ভালোবাসাবাসি করেছিলেন, তাই তাকে সিন্দুকে ভরে লুকিয়ে নিয়ে এসেছেন।

এরপর আবার সেই একই ব্যাপার। রাজা যখন খেতে যাবেন, পাগল তখন রাজাকে বলল:

"মনের দুঃখ বলি কারে,

বিবির কাণ্ড দেখে হলাম পাগল।

পাগল হয়ে লাগালাম গোল।

ডাক্তারের সঙ্গে হলো পথে যোগাযোগ,

তার ঘরে এসে দেখি একই রোগ।

চাক চাঁদার ভিতর নাগর চাঁদা,

বিবি গুনে দশ ঘা জুতো খায়,

বিবি ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যায়।

কবিরাজের নিকট নিয়ে গেল চিকিৎসার তরে,

ঐ একই রোগ দেখি কবিরাজের ঘরে।

সেখান হতে এসে পথে পথে বেড়ায়,

পথে খায় পথেই ঘুমায়।

পথ বেয়ে যায় এক সাধুজন,

বলে—‘পাগলামি কর কি কারণ!

চল আমার ঘরে দিব ঠাঁই’,

ঐ একই রোগ তার ঘরে দেখতে পাই।

দেশের রাজার সাথে পথে হলো দেখা,

পাগলকে দেখে বলে—‘পথে পথে কেন একা,

এস রাজবাড়িতে রাখব আদরে’,

ঐ একই রোগ দেখি রাজার ঘরে।

অল্প ভক্ষিতে রাজা ঘরে যায়,

পাগল রাজার পিছু পিছু ধায়।

শুনুন শুনুন রাজন, ঐ অন্ন উচ্ছিষ্ট,

করোনা ভক্ষণ। তুমি দেশের রাজা,

বিচার করে পাপীদের দাও সাজা।"

রাজা শুনে আর অন্ন ভক্ষণ করলেন না। পাগলকে শুধালেন, "কী ব্যাপার?"

পাগল এক এক করে ডাক্তার, কবিরাজ, শিক্ষক ও রাজার স্ত্রীদের উপপতিদের কথা বলল।

রাজা প্রথমে রানির, তারপর শিক্ষক, কবিরাজ ও ডাক্তারের ঘর হতে চার 'নাগরচাঁদ'-কে বার করে বিচার করলেন। তাদের পাকা দেওয়ালে জীবন্ত গেঁথে দিতে বললেন, আর চার রমণীকে বনবাসে পাঠিয়ে দিলেন।

[ সংগৃহীত: বরিশাল জেলার নিবাসী আবুল হাসান সাহেবের নিকট হতে]

Post a Comment