এক দেশে ছিল এক রাজা। রাজার পুরী করে গমগম রমরম। রাজার এক পুত্র। সুন্দর, রূপবান, গুণবান। রাজার মন্ত্রীর এক পুত্র আছে। সেও উপযুক্ত।
রাজপুত্রের সঙ্গে মন্ত্রীপুত্রের খুব ভাব। রাজা দু'জনের বন্ধুত্ব দেখে মনে করলেন, হয়তঃ দুজনে একসঙ্গে কোন রাজ্যে চলে যাবে। তাই রাজা রাজপুত্রকে এক বাগান বাড়ীতে কার্যাতঃ বন্দী করে রাখল।
মন্ত্রীপুত্র কি আর করে, মনের দুঃখে একদিন নদীর ধাবে গিয়ে বসে আছে। এমন সময় দুটো ভূত এসে হাজির। তাদের একজনের হাতে একটা কুশের জুতো, অন্যজনের হাতে একটা কুশের খড়ম। কুশের জুতোর কাজ হলো বিশ্বের যেখানে যা আছে কুশের জুতো মারফৎ তা জানা যায়, আর খড়মের কাজ হলো, তা পায়ে দিয়ে যেখানে খশী যাওয়া যায়। দু'জনেই জুতো এবং খড়ম চায়। তারা মন্ত্রীপুত্রের নিকট বিচার চাইতে এসেছে, কে জুতো পাবে।
সব শুনে মন্ত্রীপুত্র তাদের নিকট হতে খড়ম ও জুতোটি নিল এবং বিচারে ঠিক হলো ভূত দু'জনকে নদীতে ডুব দিতে হবে যে শেষে উঠবে সে জুতো ও খড়ন পাবে, যে আগে উঠবে সে কিছুই পাবে না। কথামত ভূত দুইজন জলে ডুব দিল।
মন্ত্রীপুত্র তখন খড়মের সাহায্যে রাজপুত্রের নিকট হাজির হল। রাজপুত্র তখন জুতো আর খড়মের গুনাগুন শুনে সে দুটো মন্ত্রীপুত্রের থেকে চেয়ে নিলো। কারণ সে প্রায় বন্দী হয়ে আছে। দরকার হলে খড়মের সাহায্যে কোথাও যেতে পারবে বা জুতোর সাহায্যে কোথায় কি আছে জানতে পারবে। মন্ত্রীপুত্র জুতো ও খড়ম বন্ধুকে দিয়ে চলে গেল নিজের বাড়ী।
এদিকে এই খড়ম ও জুতো ছিল রত্নাগড়ের রাজকন্যা রত্ন-মালার। ভূত দুটো রত্নাগড় হতে রত্নমালার একপাটি জুতো ও খড়ম চুরি করে এনেছিল। জুতোর সাহায্যে রাজকন্যা রত্নমালা তার চুরি-যাওয়া একপাটি জুতো ও খড়ম কোথায় আছে জানতে পারল এবং অন্য পাটি খড়মের সাহায্যে রাজপুত্রের বাগান বাড়ীতে এসে হাজির হলো।
রাত্রে এই ঘটনা ঘটল। রাজপুত্রের সঙ্গে রত্ন-মালার পরিচয় ও ভালবাসা হয়ে গেল। রত্নমালা রাজপুত্রকে নিজের পরিচয় দিল। তাকে যেন রত্নাগড়ে গিয়ে বিবাহ করে, একথা অনুরোধ করল। তারপর তার হারানো জুতো ও খড়ম নিয়ে খড়মের সাহায্যে রত্নাগড়ে চলে গেল।
পরদিনে রাজপুত্র তার পিতাকে জানাল যে রত্নাগড়ের গুণবতী রূপবর্তী রাজকন্যা রত্নমালাকে বিবাহ করবে। রাজা তখন রত্নমালার দেশ রত্নাগড়ে রাজপুত্রের বিবাহ প্রস্তাব নিয়ে একজন দূত পাঠান। রত্নাগড়ের রাজা সব শুনে দূতকে আনেক সমাদর করল। তারপর রাজপুত্রের সঙ্গে রত্নমালার বিবাহের জন্য একটা শুভ দিন স্থির করল। তারপর সেই শুভদিনে রাজপত্রের সঙ্গে রত্নমালার বিবাহ হায়ে গেল।
বিবাহের পর লোক লস্কর নিয়ে রাজপুত্র রত্নমালাকে নিয়ে দেশে ফিরে চলেছে। রাজপুত্রের দেশ আর বেশী দূরে নয়। দুপুরবেলা প্রচণ্ড রোদ। পথিমধ্যে লোক লস্কর থেমে বিশ্রাম করতে লাগল। রাজকন্যা রত্নমালা ক্লান্তির সাথে পথশ্রমে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর রাজপুত্র তার পাশে বসে আছে।
রত্নমালার গলায় ছিল একটা রত্নখচিত গজমোতির হার। হারটা সুন্দর, না রত্নমালা সুন্দর তা দেখার জন্য হারটি খুলে রোদে ধরে দেখতে লাগল। সেই সময় একটা চিল কোথা হতে উড়ে এসে ছোঁ মেরে হারটা নিয়ে চলে গেল। হতবুদ্ধি রাজপুত্র হারের জন্য চিলের পিছু পিছু ছুটতে লাগল। এইভাবে চিলের পিছু ছুটতে ছুটতে সন্ধ্যার সময় অন্য এক রাজ্যে এসে পৌঁছিল। চিলও কোথায় হারিয়ে গেল, তার আর সন্ধান পেল না।
কোথায় রত্নমালা নববিবাহিত স্ত্রী? কোথায় লোকলস্কর? রাতের আশ্রয়ের জন্য রাজপুত্র নগরে প্রবেশ করল।
রত্নমালা জেগে উঠে দেখে পাশে স্বামী নাই। গলাতে নাই হার। কি হলো? সেও হতবুদ্ধি হয়ে গেল। যাইহোক লোক-লস্কর নিয়ে সে শ্বশুর বাড়ী গিয়ে হাজির হলো। তারপর কুশের জুতোর সাহায্যে সে সবকিছু জানতে পারল। তার শ্বশুর শ্বাশুড়ী কেঁদে অস্থির।
মন্ত্রীপুত্র সকলকে স্থির হতে বলল। তারপর রাজকন্যা যুবক রাজপুত্রের ছদ্মবেশ ধারণ করে খড়মের সাহায্যে স্বামী যে রাজ্যে আছে সেই রাজ্যে গিয়ে হাজির হলো। সেখানে গিয়ে রাজাব নিকট একটা চাকরী নিল। তার কাজ হলো নদীর রাজঘাটে বিদেশী নৌকা পরিদর্শন করা। এই কাজে সে খুব সাফল্য লাভ করল।
এদিকে রত্নমালার স্বামী ছদ্মবেশে সেই রাজ্যের মালিনীর বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছে। মালিনী রোজ রাজবাড়িতে রাজকন্যাকে ফুলের মালা দিয়ে আসে। রাজপুত্র একদিন ভালভাবে একটি মালা গেঁথে দিল। মালিনী সেই মালা নিয়ে বাজকন্যাকে দিয়ে এলো।
ছদ্মবেশী রত্নমালা মালাটি দেখল আর বুঝতে পারল, এ মালা তার স্বামীর গাঁথা। সেদিন মালিনীকে ছদ্মবেশী রত্নমালা জিজ্ঞাসা করল যে, এ মালা কে গেঁথেছে? মালিনী বলল যে, তার এক প্রবাসী বোনপো এসেছে, সে গেঁথেছে এই মালা। রত্নমালা তাকে বলল যে আগামী কাল যেন তার বোনপোকে এখানে নিয়ে আসে। সেদিন মালিনীকে অনেক টাকা দিল ছদ্মবেশী রত্নমালা।
পরদিন ছদ্মবেশী রত্নমালা আবার বিদেশী নৌকা পরিদর্শনের জন্য রাজঘাটে গেল। দেখল একটা বড় নৌকা আসছে। নৌকায় ছইয়ের উপর সে একটা চক্চকে দ্রব্য দেখতে পেল। তখন ছইয়ের উপর কোন লোক ছিল না। সেখানেও কেহ ছিল না। রত্নমালা সহসা সেই নৌকার ছইয়ের উপর উঠে গেল। দেখল সেখানে বসে আছে এক চিল। চিলের পায়ে একটা মৃত পাখী, আর মৃত পাখীর হাত খানেক দূরে পড়ে আছে তার গজমোতি হার। হারটি সে তাড়াতাড়ি কুড়িয়ে নিল। চিলটা ভয়ে মৃত পাখীটা নিয়ে উড়ে গেল।
পরদিন মালিনী তার বোনপোকে বাড়ী নিয়ে এলো। বন্ধুমালা তার স্বামীকে পেয়ে খুব খুশী। তখন সে ছদ্মবেশ ত্যাগ করল। রাজকন্যা সবদেখে অবাক হয়ে গেল। রত্নমালা তখন রাজকন্যাকে সব বলল, মালিনীর বোনপোবেশী রাজপুত্রও সব বলল। রাজপুত্র রত্নমালাকে নিয়ে দেশে ফিরে গেল।
[ বাংলার লোককথা (১৯৮৭ ) - মোহাম্মদ আইয়ুব হোসেন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে (মূল মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার কাগ্রাম নিবাসী শ্রীঅসীম কুমার মুখোপাধ্যায়ের নিকট হতে সংগৃহীত)]
