এক দেশে ছিল এক রাজা। তাঁর ছিল একমাত্র পুত্র—রূপবান যুবক, কিন্তু কিছুটা বোকা বা সরল প্রকৃতির। সেই রাজ্যের এক গ্রামে বাস করত এক বুড়ী। বুড়ীর না ছিল পুত্র, না ছিল কন্যা। অনেক দিন হলো তার স্বামী মারা গেছেন।
একদিন সকালে বুড়ী হাঁস-মুরগীকে দানা খাওয়াচ্ছিল। ঠিক সেই সময় একটি কাক একটি ইঁদুরছানাকে মুখে করে নিয়ে কামড়াকামড়ি করছিল। বুড়ী কাকের মুখ থেকে ইঁদুরছানাটি ছাড়িয়ে নিল এবং তার ক্ষতস্থানগুলোতে গরম হলুদ লাগিয়ে দিল। ছানাটি ছিল মাদী, বুড়ী তার নাম রাখল 'চুনী'।
ধীরে ধীরে চুনী বেশ বড় হলো। বুড়ী ঠিক করল চুনীর বিয়ে দিয়ে তাকে ইঁদুরের গর্তে ছেড়ে দেবে। তাই চুনীকে হলুদ মাখিয়ে স্নান করাল। সেই হলুদ মাখা জল নালা দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল। ঐ রাজার ছেলে কোনো এক কাজে বুড়ীর বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। হলুদ মাখা জল দেখে সে ভাবল, নিশ্চয়ই কোনো রূপবতী মেয়ে স্নান করছে, আর তার রূপের রঙ ধুয়ে জল বেয়ে আসছে!
রাজপুত্র বুড়ীর বাড়ি গিয়ে হাজির হলো। বুড়ী রাজপুত্রকে একটি শীতল পাটি বিছিয়ে দিল। রাজপুত্র বলল, "তোমার বাড়িতে একটি সুন্দরী মেয়ে আছে; তার সঙ্গে আমার বিয়ে দাও।"
বুড়ী হেসে বলল, "বাবা আমার, কোনো মেয়ে তো নাই। তবে চুনী নামে আমার কাছে একটি ইঁদুর-কন্যা আছে, তাকেই হলুদ মাখিয়ে স্নান করাচ্ছিলাম। তুমি সেই জল দেখেছ।"
রাজপুত্র ছিল জেদী। সে বলল, "ঐ ইঁদুর-কন্যা চুনীকেই সে বিয়ে করবে।"
শেষমেশ চুনীর সঙ্গে রাজপুত্রের বিয়ে হলো। রাজপুত্র বুড়ীকে খুব সাবধানে চুনীকে রেখে দিতে বলে নিজে বাড়ি ফিরে গেল।
রাজপুত্র বাড়ি চলে আসার পর রাজা-রাণী পুত্রকে বড় হয়েছে দেখে তার বিয়ের তোড়জোড় শুরু করলেন। রাজপুত্র বলল, "চুনী নামে একটি মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। অতএব আর বিয়ের প্রয়োজন নাই।"
রাজা-রাণী বধূকে দেখতে চাইলেন। রাজপুত্র বলল, "সময় হলেই সে আসবে।" অবশেষে মা-বাবার পীড়াপীড়িতে রাজপুত্র চুনীকে নিয়ে এলো এবং এক বাগানবাড়িতে চাবি দিয়ে রেখে দিল। চুনী সেখানেই থাকত।
একদিন রাণী এক হাঁড়ি কলাই দিলেন খোসা ছাড়ানোর জন্য। রাজপুত্র সেই কলাই নিয়ে চুনীকে দিয়ে এলো ও খোসা ছাড়াতে বলল। চুনী দাঁত দিয়ে সুন্দর করে খোসা ছাড়িয়ে দিল। রাণী খোসা ছাড়ানো দেখে খুব খুশি হলেন। ছেলেকে বললেন, "বৌমা'র কাজ তো খুব ভালো।"
আরেক দিন রাণী খই ভাজলেন। গুড় মাখিয়ে খই-এর মোয়া তৈরি হবে। খই ভাজা হলে তিনি ধান ছাড়ানোর জন্য চুনীর নিকট পাঠালেন। রাজপুত্র চুনীকে খই দিয়ে ধানগুলো ছাড়াতে বলল। চুনী সুন্দর করে ধান ছাড়িয়ে দিল। খইয়ের ধান ছাড়ানো দেখে রাণী আরও খুশি হলেন এবং বধূকে দেখতে চাইলেন। রাজপুত্র অজুহাত দেখাল, "চুনীর এখন একটি ব্রত চলছে, কোনো লোকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারবে না।"
রাজার একদিন পিঠেপুলি ও আঁদসা খাবার ইচ্ছা হলো। রাণী বললেন, "চুনীকে পাঠিয়ে দিই। তার হাতের কাজ খুব ভালো। সে খুব ভালো পিঠে, আঁদসা তৈরি করবে।" রাজপুত্র বলল, "সব কিছু দাও, চুনীকে দিয়ে আসি।"
আটাপ চালের আটা, আঁখ ও খেজুর গুড়, সরিষার তেল, লোহার ও মাটির খোলা এবং ছাঁচ—সব পাঠিয়ে দেওয়া হলো। রাজপুত্র ভাবছে, চুনী কিভাবে পিঠেপুলি-আঁদসা তৈরি করবে? যাইহোক, সে সব দিয়ে এলো।
চুনী তখন আর কী করে! একবার আটার উপর, একবার গুড়ের উপর, একবার তেলের উপর লাফালাফি করতে লাগল। ঠিক সেই সময় চারজন পরী আকাশপথে উড়ে যাচ্ছিল। চুনীর লাফালাফি দেখে কৌতূহলী হয়ে তারা নিচে নেমে এলো এবং চুনীর নিকট আগাগোড়া সব কথা শুনল।
পরীরা তখন মন্ত্রবলে চুনীকে রূপবতী, সুশ্রী যুবতী করে দিল। সোনার কাজ করা শাড়ি, জামা, সোনা, হীরে, জহরতের অলঙ্কার দিয়ে তাকে সাজাল। আর সবচেয়ে ভালো পিঠেপুলি ও আঁদসা তৈরি করে দিয়ে গেল।
চুনী সেগুলি একটা কাঠের থাবায় সাজিয়ে রেখে দিল। সে নিজেও ভক্তাপোশের (বিছানার) নীচে লুকিয়ে রইল।
সকাল হলে রাজপুত্র তো এ সব জানে না। সে পিঠেপুলি-আঁদসার থাবা নিয়ে ঘরে চাবি দিয়ে চলে গেল। রাজা-রাণী পিঠেপুলি-আঁদসা দেখে অবাক! "এত সুন্দর যার হাতের কাজ, সে মেয়ে না জানি কি সুন্দরী!"
তাই জোর করে পুত্রের নিকট থেকে ঘরের চাবি নিয়ে রাজা-রাণী বাগানবাড়ি চলে এলেন। রাজপুত্রও এলো। সে বুঝল, আজ তো সব জানাজানি হয়ে যাবে।
রাণী চাবি দিয়ে তালা খুলে ঘর খুললেন। দেখলেন, এক রূপসী রাজকন্যা বসে আছে। রাজা-রাণী চুমা খেয়ে পুত্রবধূকে ঘরে আনলেন। এতদিন তাকে বন্দী করে রাখার জন্য পুত্রকে খুব বকলেন। কিন্তু পুত্র বুঝতে পারল না, কিভাবে চুনী মানুষ হলো।
চুনী সন্ধ্যার সময় স্বামীকে সব কথা বলল। এরপর তারা সুখে-শান্তিতে সংসার করতে লাগল।
[ বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানার অজয় তীরবর্তী চরখী গ্রাম নিবাসিনী বেগম মহবুবা খানের নিকট হতে সংগৃহীত।]
