চার বিলাস

ছোটদের গল্প রূপকথার গল্প

এক দেশে ছিল এক রাজা। রাজা তাঁর মন্ত্রী, সেনাপতি আর বণিক—এই তিনজনের পরামর্শে রাজ্য চালাতেন। রাজা খুব খুশি। রাজ্যে কোনো ঝামেলা নেই, ঝঞ্ঝাট নেই। কিছুদিন পর রাজার স্ত্রী (বিবি) একটি পুত্রসন্তান প্রসব করলেন। এরপর কিছুদিন পরপর মন্ত্রী, সেনাপতি ও বণিকের স্ত্রীরাও একটি করে পুত্রসন্তান প্রসব করলেন। চারজন কুমার একসাথে খেলাধুলা করে, আর একসাথে পড়াশোনা করে। এমনি করে দিন যায়। চার বন্ধু একসাথে লেখাপড়া, যুদ্ধবিদ্যা, ঘোড়ায় চড়া—সবকিছু শিখল।

চার বন্ধু ঘোড়ায় চড়তে খুব ভালোবাসত। রাজা আরব দেশ থেকে একই রঙের, একই রকম চারটি তেজস্বী ঘোড়া এনে দিলেন রাজপুত্র আর তাঁর বন্ধুদের জন্য। চার কুমার দিনরাত মনের সুখে ঘোড়া ছুটিয়ে ঘুরে বেড়াত।

এই চার কুমারের মধ্যে প্রত্যেকের একটি করে বিশেষ বিলাস ছিল।

রাজপুত্র ভালো চালের, ভালোভাবে রান্না করা অল্প খাবার খেতে ভালোবাসত। চাল খারাপ হলে বা রান্না ভালো না হলে সে খেতে পারত না। তাই তাঁকে বন্ধুরা বলতো ‘অন্নবিলাস’।

মন্ত্রীর পুত্রের নজর ছিল বিছানার দিকে। সুন্দর পরিপাটি বিছানা না হলে শুয়ে তাঁর ঘুম আসতো না। তাই বন্ধুরা তাঁকে বলতো ‘শয্যাবিলাস’।

সেনাপতির পুত্র ভালোবাসতো নিখুঁত ও সুশ্রী নারী। নারীর মধ্যে সামান্য একটু খুঁত থাকলে সে পিছিয়ে আসত। বন্ধুরা তাই তাঁকে বলতো ‘নারীবিলাস’।

বণিকের পুত্র ভালোবাসতো পান খেতে। তবে পান হওয়া চাই সতেজ, নিখুঁত ও সুগন্ধযুক্ত। পচা, ছেঁড়া, দুর্গন্ধযুক্ত পান হলে সে খেতো না। তাই তাঁর নাম দিয়েছিল বন্ধুরা ‘পানবিলাস’।

একদিন চার বন্ধুতে যুক্তি করল, তারা দেশ ভ্রমণে যাবে, কারণ বাড়িতে বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না।

একদিন ভোরে চার বন্ধু ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল আর এক দেশে। সেই দেশের রাজার ছিল খুব ঘোড়ার শখ। এই রাজা আরব থেকে চারটে একই রঙের ঘোড়া কিনে এনেছিলেন। ঘোড়াগুলো দেখতে ছিল রাজপুত্র ও তাঁর বন্ধুদের ঘোড়ার মতো। কিছুদিন হলো, এই রাজার ঘোড়া চারটি চুরি হয়ে গেছে। আর তার কয়দিন পর রাজপুত্র ও বন্ধুরা এই রাজার রাজ্যে বেড়াতে এসেছে।

রাজার রাজধানী ঢুকতেই আছে একটি বাগানবাড়ি। পুকুরের চারিপাশে ভালো ভালো গাছ। সেই গাছে ঘোড়া বেঁধে তারা বিশ্রাম করতে লাগল।

এদিকে রাজা তাঁর কর্মচারীদের হুকুম দিয়েছেন, সাতদিনের মধ্যে ঘোড়া এনে দিতে না পারলে গর্দান যাবে। রাজকর্মচারীরা বাগানবাড়িতে ঘোড়াসহ রাজপুত্র ও তাঁর বন্ধুদের ধরে রাজার নিকট নিয়ে গেল ও বন্দী করে রাখল। চার কুমার বলাবলি করছে, "এ কী হলো? আমরা শেষ পর্যন্ত চোরের দায়ে ধরা পড়লাম!"

এদিকে রাজার কন্যা ঐ বাগানবাড়ির পাশে থাকেন। রোজ ঘোড়া আর তার মালিকদের দেখে তাঁর মনে হয়েছিল এরা বেশ ভালো লোক। সেদিন ঘোড়া বা কুমারদের দেখতে না পেয়ে তিনি সখীদের পাঠালেন খবর নিতে। সখী রাজকন্যাকে এসে জানাল, ঐ কুমাররা রাজার ঘোড়া চুরির দায়ে ধরা পড়েছে এবং তাদের বিচার হবে।

রাজকন্যা পিতাকে গিয়ে বলল, "বাবা, এই চারজন চোর নয়। এরা পরিচয় গোপন করে এখানে বেড়াতে এসেছে বলে মনে হয়। এদের পরীক্ষা করা হোক।"

রাজা কন্যাকে শুধালেন, "কীভাবে পরীক্ষা করা যায়?”

রাজকন্যা বলল, "এরা কী ভালোবাসে, সেটা জেনে, তাই দিয়ে পরীক্ষা করা হোক।"

রাজা চার ঘোড়া-চোরকে দরবারে হাজির করতে বললেন। দরবারে রাজা তাঁদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। তাঁরা বললেন, "আমরা দামোদরপুর রাজার পুত্র, মন্ত্রীর পুত্র, সেনাপতির পুত্র ও বণিকের পুত্র।"

এই কথা শুনে রাজা বললেন, "তোমরা কে কী ভালোবাসো?"

এই কথা শুনে রাজপুত্র বললেন, "আমি অন্নবিলাস, ভালো অন্ন খেতে ভালোবাসি।"

মন্ত্রীপুত্র বললেন, "আমি শয্যাবিলাস, আমি ভালো বিছানায় শুতে ভালোবাসি।"

বণিকপুত্র বললেন, "আমি পান-বিলাস, ভালো পান খেতে ভালোবাসি।"

এই কথা শুনে রাজা ভালো সরু চাল এনে তার পোলাও তৈরি করে রাজপুত্রকে খেতে দিলেন। রাজপুত্র এক গ্রাস খেয়ে থুথু করে মুখের ভাত ফেলে দিল।

রাজা শুধালেন, "কী হলো?"

রাজপুত্র বললেন, "এ ভাত আমি খেতে পারবো না। ভাতে শ্মশানের ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছি।"

রাজা এই কথা শুনে বললেন, "ডাক ভাগুড়েকে ডাক।"

ভাগুড়ে রাজার আদেশ পেয়ে কাঁপতে কাঁপতে হাজির হলো। রাজা বললেন, "বল বেটা, এ ধান কোন জমির?”

ভাগুড়ে বলল, "মহারাজ, এ ধান শ্মশানের ধারে এক ভালো জমির।"

রাজপুত্রের কথা ঠিক ঠিক মিলে গেল।

এরপর মন্ত্রীপুত্রের জন্য ভালো তোষক দিয়ে খাটের উপর বিছানা পেতে শুতে দেওয়া হলো। রাজা তাঁর এক কর্মচারীকে রাখলেন দরজার কাছে, মন্ত্রীপুত্র রাতে কী করে তা দেখার জন্য। কর্মচারী দেখল মন্ত্রীপুত্র সারারাত না ঘুমিয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করছে। সকাল হলে কর্মচারী রাজাকে সব জানাল।

রাজা শয্যাবিলাসকে শুধালেন, "কী ব্যাপার? এত ভালো বিছানায় শুয়েও তুমি ঘুমোওনি কেন?"

শয্যাবিলাস বললেন, "মহারাজ, তোষকের ভিতরে মাঝখানে এক ছিটে লম্বা চুল আছে। এই চুল ছিটুর জন্য সারারাত ঘুম হলো না।"

রাজা তোষক ফেড়ে দেখলেন, সত্যিই তার মধ্যে এক ছিটে চুল আছে।

এরপর নারীবিলাসকে ডাকা হলো। রাজার মালিনীর একটি পালিত কন্যা ছিল। যেমন রূপসী তেমনি সুঠাম চেহারা। এখনও তার বিয়ে হয়নি। রাজা মালিনীকে অনেক টাকা দিয়ে মেয়েটিকে এক রাতের জন্য নিলেন। মেয়েটিকে খুশবু (সুগন্ধী) সাবান মাখিয়ে স্নান করিয়ে সুগন্ধী দ্রব্য ও ভালো ভালো কাপড়-গহনা পরিয়ে নারীবিলাসের ঘরে রাতে দেওয়া হলো, আর রাতে সে কী করে দেখার জন্য দরজার কাছে রাখা হলো এক কর্মচারী।

নারীবিলাসের পাশে মেয়েটি শুয়ে পড়ল। নারীবিলাস একবার মেয়েটির দিকে মুখ করে আবার ফিরিয়ে নিয়ে থু থু করে থুথু ফেলে আর বমি করে। সারারাত এইভাবে চলল। ভোরে নারীবিলাস উঠে এল। কর্মচারী রাজাকে সব খবর দিল।

রাজা নারীবিলাসকে শুধালেন, "কী হে! সারারাত বমি করেছ! কেন?"

নারীবিলাস বললেন, "এই মেয়েটির গায়ে ছাগলের দুধের গন্ধ। আমি ছাগলের দুধের গন্ধ সহ্য করতে পারি না, তাই সারারাত মেয়েটির দিকে মুখ করেছি আর ছাগলের দুধের গন্ধ পেয়েছি, আর সাথে সাথে আমার বমি হয়েছে।"

রাজা কর্মচারীকে হুকুম দিলেন, "ডাক মালিনীকে।"

মালিনীকে শুধানো হলো, "এই কন্যার গায়ে ছাগলের গন্ধ কেন?"

মালিনী বললেন, "মহারাজ, এই মেয়েটিকে জন্ম দিয়ে এর মা মারা যায়। এর মা ছিল আমার বোন। এই সময় আমার একটি খাসি ছাগল বিয়িয়েছিল। মা-হারা মেয়েটি সেই ছাগলের দুধ খেয়ে মানুষ হয়েছে।"

রাজা বললেন, "হ্যাঁ, তুমি সত্যিই নারীবিলাস।"

এরপর পানবিলাসের পরীক্ষা। রাজার হুকুমে সুন্দর, সতেজ, নিখুঁত পান এনে সেই পানকে দুইশত বাহান্ন রকমের মশলা দিয়ে সাজানো হলো ও পানবিলাসকে খেতে দেওয়া হলো। পানবিলাস পান মুখে দিয়ে একবার চিবিয়ে তা থু থু করে ফেলে দিল।

রাজা বললেন, "কী হলো?"

পানবিলাস বললেন, "পানের মধ্যে আলান সাপের গন্ধ পাচ্ছি।"

যে পান এনেছিল, তাঁকে নিয়ে রাজা চলে গেলেন পানের বরজে। যে পানলতা হতে পান নেওয়া হয়েছিল, তার গোঁড়া খোঁড়া হলো। বেরিয়ে এল আলান সাপ।

রাজা বললেন, "হ্যাঁ, তুমি পানবিলাস।"

তারপর ঘোড়া সমেত তাঁদের ছেড়ে দিলেন রাজা। তাঁর কন্যার সাথে রাজপুত্রের বিবাহ দিলেন।

 [লোককথাটি বীরভূম জেলার নানুর থানার রামঘাটি গ্রামের কানিকুড়ো শাহ ফকিরের নিকট হতে সংগৃহীত]

Post a Comment