এক গাঁয়ে ছিল এক চাষী পরিবার। সেই গাঁয়ের পশ্চিম দিকে ছিল এক পীরের দরগা। পীরের দরগায় হিন্দু-মুসলমান সকলেই ভক্তি করে সিন্নি দিত। এই চাষীর ছিল পাঁচ বড় ছেলে ও একটি ছোট ছেলে। এই চাষী এবং তার স্ত্রী বড় পাঁচ ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলেন। চাষীর ছোট ছেলেটি ছিল রোগা-পটকা। চাষী দেখলো তার এই ছোট ছেলেটা বাঁচবে না। তাই সে ছেলেটাকে নিয়ে গেল পীরের দরগায়। তারপর দরগার চাতালে ছেলেটাকে শুইয়ে দিয়ে পীরকে উদ্দেশ্য করে বললো, "পীরবাবা, এই ছেলেটিকে তোমাকে দিলাম। মারতে হয় মারো, রাখতে হয় রাখো।" এই বলে ছেলেটিকে দরগার চাতালে রেখে চাষী চলে এলো।
রাত্রিতে পীর সাহেব ফকিরের বেশ ধরে এসে ছেলেটির কপালে একটি সিঁদুর দিয়ে দিলেন। আর রাতের মধ্যেই ছেলেটার স্বাস্থ্য ভালো হয়ে গেলো। পীর সাহেব স্বপ্নে দর্শন দিয়ে চাষীকে বললেন, "তোর ছেলেকে নিয়ে গিয়ে মানুষ কর। ছেলেটাকে তোকে ফেরত দিলাম। এ ছেলে এখন থেকে আমার; কোনো বিপদ হলে আমাকে বলবি।"
কিছুদিন পর চাষী আর তার স্ত্রী ছোট ছেলেটাকে বড় বৌ-এর হাতে তুলে দিয়ে বললো, "বৌমা, এই সিঁদুরকে (চাষী ছেলেটির নাম রেখেছিল সিঁদুর, কারণ পীর সাহেব তার কপালে সিঁদুরের টিপ দিয়েছিল) তোমাকে দিলাম। একে তুমি নিজের ছেলের মতো মানুষ করো। আমরা তীর্থ করতে যাবো। কখন ফিরবো জানি না। তাছাড়া পথিমধ্যে মৃত্যুও হতে পারে (তখন তীর্থযাত্রা ছিল দুর্গম পথে, পথিমধ্যে অনেকের মৃত্যু ঘটত)।" চাষী আরও বললো, "সিঁদুরের কোনো বিপদ হলে পীরের কাছে গিয়ে সব কথা বলে পীরের সাহায্য চেয়ো।" এই কথা বলে চাষী আর তার স্ত্রী তীর্থ করতে চলে গেলো।
বড় বৌ সিঁদুরকে নিজের ছেলের মতো মানুষ করতে লাগলো। বড় বৌ-এর কোনো ছেলেপিলে ছিল না। সিঁদুর বড় বৌকে মা বলতো। বড় বৌ ছাড়া চাষীর বাকি চার ছেলের বৌ ছিল খুব বদ।
এই গাঁয়ের উত্তর দিকে, একেবারে গাঁয়ের শেষে বাস করতো এক মালিনী। সে জানতো জাদুবিদ্যা। তার বাড়ির লাগোয়া ছিল নানা ফল-ফুলের গাছ-ঘেরা একটা বাগান ও একটি পুকুর। এই পুকুরে গা ধোয়ার ছলে আসতো নষ্ট চরিত্রের মেয়েরা। তারা তাদের উপপতিদের সঙ্গে বাগানে বসে হাসি-আমোদ করতো। চাষীর বাকি চারটি বৌ মালিনীর বাগানে স্নান করার ছলে এসে তাদের উপপতিদের সাথে হাসি-আমোদ করতো। এমনিভাবে দিন যায়।
দৈব গতিতে সিঁদুর একদিন খেলা করতে করতে এসে পড়লো মালিনীর বাগানে। আর দেখতে পেলো বৌদিদের কাজকর্ম। বৌদিরা দেখলো সিঁদুর সব দেখেছে, আর তাদের আর রক্ষে নাই। সিঁদুর বাড়ি গিয়ে সব বলে দেবে। বড় বৌ এই সময় বাড়িতে ছিল না। এই চার বৌ বাড়ি এসে ঢেঁকিতে ধান কুটতে গেলো আর সিঁদুরকে বললো গড়ে সেঁকে দিতে। তারপর ছেলেটিকে ঢেঁকিতে কুটে একটা বোরায় ভরে ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে এলো।
শকুন নেমে এসে বোড়ার মধ্যে মুখ ভরে খেতে লাগলো কোটা মাংস। বড় বৌ বাড়ি এসে অনেক খোঁজ করেও সিঁদুরের দেখা না পেয়ে শ্বশুর-শাশুড়ীর কথামতো পীরের দরগায় গিয়ে বললো, "বাবা পীর সাহেব, তোমার সিঁদুরকে পাচ্ছি না।" পীর সাহেব ধ্যানযোগে সব জেনে ফকিরের বেশ ধরে ভাগাড়ে গিয়ে শকুনকে বললো, "আমাকে বোড়ার ভিতর থেকে একটা হাড় বার করে দে।" হাড় সব প্রায় গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল। কোনো রকমে একটা হাড় বোড়ার ভিতর হতে বার করে ফকিরের হাতে দিলো। পীর সাহেব সেই হাড় হাতে নিয়ে দোয়া পড়ে ফুঁ দিলো। দেখলো সিঁদুর সামনে দাঁড়িয়ে, তার দুই হাতে দুটো সোনার ভাঁটা। দুই হাতে দুই সোনার ভাঁটা নিয়ে হাসতে হাসতে সিঁদুর বাড়ি গেলো। বড় বৌদি তাকে দেখে খুব খুশি। এদিকে ঐ চার বৌদি নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে, "এ কী হলো!" যাই হোক, এমনি করে দিন যায়। ক্রমে ক্রমে সিঁদুর আরও বড় হলো।
এদিকে ঐ দুষ্ট চার বৌদি মালিনীর বাড়িতে স্নান করার ছলে রোজই যায়। খেলতে খেলতে কিশোর সিঁদুর আবার ঐ মালিনীর বাড়িতে গিয়েছে। চার বৌদি তখন তাদের চার উপপতির সঙ্গে হাসি-মস্করা করছে। বৌদিরা ভাবলো, সিঁদুর সব বলে দেবে, তাদেরও জাত-মান দুই-ই যাবে। তাই সিঁদুরকে চার জা-য়ে চান করাতে পুকুরে নিয়ে গেলো। আর চান করবার ছলে জলে ডুবিয়ে মেরে দিয়ে জলের নীচে শাপলাদলের গোড়ায় পুঁতে দিলো।
এদিকে বড় বৌদি ছেলেকে পায় না। একদিন পর সে আবার গেলো পীরের দরগায়। জোড় হাতে বললো, "বাবা পীর সাহেব! তোমার সিঁদুরকে খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি তার ব্যবস্থা করে দাও। তুমি এর আগে তো একবার তাকে ফিরিয়ে দিয়েছো।" এই বলে বড় বৌ চলে গেলো।
পীর সাহেব ধ্যানযোগে সব জানতে পারলেন। তারপর তিনি মালিনীর পুকুরে গিয়ে সিঁদুরকে বাঁচিয়ে দিলেন। মালিনীর বাড়ির পাশে ছিল এক বন, সেই বনে থাকতো এক বনদেবী। সে যেমন রূপসী, তেমনি সুন্দর। তখনও তার বিয়ে হয়নি। পীর সাহেব তাকে নিজের মেয়ের মতো দেখতো। বনদেবীও পীর সাহেবকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতো।
পীর সাহেব ধ্যানযোগে দেখলেন সিঁদুরের কপালে এখনও বিপদ আছে। আর সেই বিপদটা বড়। তার জন্য চাই একটি বুদ্ধিমতী মেয়ে। তাই পীর সাহেব বনদেবীকে বললেন, "তুমি সিঁদুরকে বিয়ে করো। তুমি পারবে সিঁদুরকে বিপদ থেকে বাঁচাতে।" সেই বনে পীর সাহেবের সামনে কিশোর সিঁদুরের সাথে বনদেবীর বিয়ে হয়ে গেলো। বৌ নিয়ে সিঁদুর বাড়ি এলো। বড় বৌ সিঁদুরকে পেয়ে খুব খুশি। বৌকেও বরণ করে নিলো। নতুন বৌ সংসারে আসতে সংসারের উন্নতি হতে লাগলো।
ঐ দুষ্ট চার বৌ মালিনীকে গিয়ে সব কথা বললো, কেমন করে প্রথম বারে ও দ্বিতীয় বারে সিঁদুরকে মেরে পথের কাঁটা দূর করেছিল। মালিনী সব শুনে বললো, "আমি জাদুবিদ্যা জানি। সেই জাদুবলে আমি সিঁদুরকে পাখি করে কোনো সুলুক দিয়ে উড়িয়ে দিবো। সে উড়ে চলে যাবে, তোদের পথের কাঁটা দূর হবে।" এই কথা বলে মালিনী তার পুকুর হতে একটা কালো পোকা ধরে আনলো। সেই পোকার ডানা দিয়ে একটা টিপ তৈরি করলো। অমাবস্যা রাতে উলঙ্গ হয়ে সেই টিপ নিয়ে পুকুরের চারপাশে ঘুরলো মালিনী। তারপর টিপটা সে তুলে রাখলো একটা নিমগাছের কোটরে।
কয়েকদিন পর বেড়াতে বেড়াতে সিঁদুর আবার এলো মালিনীর বাড়ি। মালিনী আর তার চার বৌদি ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাকে নিয়ে গেলো সেই নিমগাছের কাছে। তারপর মালিনী চটপট টিপটা কোটর হতে তুলে নিয়ে চটচটে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিলো সিঁদুরের কপালে। সঙ্গে সঙ্গে হলুদ, সবুজ, কালো রঙের পাখি হয়ে সিঁদুর উড়ে গেলো। কেমন পাখি হয়ে সিঁদুর উড়ে গেলো সেটা তার বৌদিরা বা মালিনী জানতে পারলো না।
পাখি হয়েও সিঁদুরের জ্ঞান ছিল। সে উড়ে গিয়ে বসলো তার স্ত্রী বনদেবীর কাঁধে। সুন্দর পাখিটা পেয়ে বনদেবী খুব খুশি। একটা খাঁচা এনে পাখিটাকে সে রেখে দিলো খাঁচার মধ্যে। রাত্রে বনদেবী পাখির কপালের টিপটা খুলে দেয়, সিঁদুর তখন মানুষ হয়ে যায়, খাওয়া-দাওয়া করে। ভোর হলে সিঁদুরের কপালে টিপটা লাগিয়ে দেয়, সিঁদুর হলুদমণি পাখি হয়ে খাঁচায় থাকে। এমনি করে দিন যায়।
বেশ কয়েক বছর পর সিঁদুরের মা-বাবা তীর্থ সেরে বাড়ি ফিরে এলো, আর সিঁদুরের খোঁজ করলো। বড় বৌ সব কথা বললো, আর সিঁদুরের বৌকে দেখালো। সিঁদুরের বাবা-মা সিঁদুরের খোঁজ করতে লাগলো। কিন্তু সিঁদুরের খোঁজ পেলো না। সিঁদুরের বৌ তখন বললো, "আমি যদি সতী কন্যা হই, তাহলে আমার স্বামী ফিরে আসবে। তবে যারা অপরাধী তাদের বিচার করতে হবে।" সিঁদুরের দাদা বললো, "অপরাধীর বিচার হবেই।" তখন মা, বাবা, চার দাদা ও বড় বৌকে সিঁদুরের বৌ সব কথা বললো।
দোষী হলো সেই মালিনী। গ্রামের ছেলে-মেয়েদের চরিত্র নষ্ট করে পয়সা উপার্জন করছে সে। তাকে শাস্তি দিলেই সব শান্তি। সে অনেক ব্রত জানতো। সিঁদুরদের বাড়ির উত্তরে যে চাতাল জায়গা পড়েছিল, সেই চাতালের মধ্যস্থলে একটা কুয়ো খোঁড়া হলো। তারপর তার ওপর পাটের কাঠি বিছিয়ে দিয়ে একটি ভালো আসন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো। আগের দিন সিঁদুরের বড় বৌদি তাকে বলে এসেছিল যে তাদের একটা ব্রত করে দিতে হবে। সকালে মালিনী ব্রত করতে এসে কুয়োর মধ্যে পড়ে গেলো। আর মাটি চাপা দেওয়া হলো তাকে।
দুষ্ট চরিত্রের চার বৌ-এর মাথা নেড়া করে এক কাপড়ে বাড়ি হতে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। তারপর চার ভাই-এর জন্য ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দেওয়া হলো। তারপর পীর সাহেব আর বনদেবীর শুভেচ্ছা নিয়ে তারা বসবাস করতে লাগলো। বনদেবী তো বৌ হয়ে তাদের বাড়িতেই থেকে গেলো।
[ভোলা জেলার দৌলতখাঁন থানার নিরক্ষর চাষী শ্রীমদন মাঝির নিকট হতে সংগৃহীত।]
