বাংলার পটুয়ারা কেন পট আঁকে? তার পেছনে একটি প্রাচীন কাহিনি আছে।
অতি প্রাচীনকালে আরব দেশে ছিল এক প্রতাপশালী বাদশা। তাঁর ছিল বিরাট রাজ্য। হস্তিশালে হাতি, অশ্বশালে ঘোড়া, লোকলস্কর, উজির-নাজির নিয়ে রাজপুরী গমগম করত।
এই রাজার রাজ্যের দক্ষিণ দিকে ছিল এক গহীন বন, যার কোনো শেষ ছিল না। সেই বনে বাস করত এক ভয়ংকর দৈত্য। সে প্রতিদিনের আহারের জন্য রাজার ক্ষেতে এসে ফসল নিয়ে যেত। ফলে প্রজাদের আহার কম পড়ত। এর জন্য প্রতি বছর অন্নের অভাবে অনেক প্রজা মারা যেত।
রাজা অনেক চেষ্টা করেও দৈত্যটিকে মারতে পারলেন না। তখন রাজা দৈত্যের সঙ্গে একটি চুক্তি করলেন। ঠিক হলো যে, প্রতিদিন তার জন্য ভালো ভালো খাবার বনের এক বড় বটগাছের নিচে রেখে আসা হবে। দৈত্য তাই খাবে এবং প্রজাদের ক্ষেতের ফসল নষ্ট করবে না।
দৈত্য দেখল যে, যদি বসে বসে খাবার পাওয়া যায়, তবে কে আর কষ্ট করে মাঠে মাঠে ঘুরতে যাবে? তাই দৈত্য রাজার কথায় রাজি হলো।
রাজা কিন্তু দৈত্যের অগোচরে ঘোষণা করলেন, যে দৈত্যকে মারতে পারবে, তাকে বহু টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। সেই পুরস্কারের লোভে বহু শক্তিশালী ব্যক্তি দৈত্যের কাছে গেল, কিন্তু তাদের সবাই তার হাতে মারা গেল।
বাংলা মুলুকে সমুদ্রের ধারে এক গ্রামে এক গরিব লোক বাস করত। তার ছিল এক বলবান পুত্র। আরব দেশের লোকেরা নৌকা নিয়ে এই সব এলাকায় নানা জিনিস কিনতে আসত। কথায় কথায় তারা দৈত্যের অত্যাচারের কথা বলল। গরিব লোকটির সেই বলবান ছেলেটি সব কথা শুনে ঐ আরব ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নৌকায় চেপে দৈত্য মারতে আরব দেশে যেতে চাইল।
আরবের লোকেরা বলল, "দৈত্য খুব শক্তিশালী, সে দিনে তিন মণ খাবার খায়। বহু লোককে সে মেরেছে। তুমি গরিবের ছেলে, তার সাথে পারবে না, মরে যাবে। তুমি যেও না।"
ছেলেটি বলল, "আমি গরিব, ভালো করে খেতে পাই না। যদি মারতে পারি, অনেক টাকা পাব। আর মরে গেলেও ক্ষতি নাই। গরিব মানুষ, একদিন তো মরতেই হবে। না খেয়ে কেন মরি? একটা ভালো কাজের জন্য প্রাণ যাবে।" এই কথা শুনে আরবের ব্যবসায়ীরা তাকে নৌকায় তুলে আরব দেশে নিয়ে গেল।
তারপর ঐ ব্যবসায়ীরা বলবান ছেলেটিকে বাদশার কাছে নিয়ে গেল। বাদশা ছেলেটির চেহারা দেখে ও কথা শুনে খুব সন্তুষ্ট হলেন, কারণ সে একটা মহৎ কাজে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত।
কয়েক দিন সে রাজার আশ্রয়ে থেকে ভালোভাবে আহার করল এবং মল্লযুদ্ধও শিখল। রাজার যেদিন খাবার পাঠানোর পালা পড়ল, সেদিন সেই বলবান যুবকটি বনে গেল খাবার নিয়ে। আতপ চাল, পাকা কলা, চারটে আস্ত রান্না করা ভেড়া, এক মণ মিষ্টি, একগাদা ভালো ভালো ফল আর দুধ—এই সব। সে এগুলি সেই বনের বটগাছটার নিচে রেখে 'দৈত্য, দৈত্য' বলে ডাকে আর নিজে খায়।
এদিকে দৈত্য বুড়ো হয়ে এসেছিল। একজন মানুষকে তার খাবার খেতে দেখে সে রেগে তাকে মারতে গেল। দু'জনের মধ্যে শুরু হলো তুমুল লড়াই। যুদ্ধ করতে করতে দুইজনে চলে গেল গভীর বনের ভেতরে। একবার দৈত্য নিচে পড়ে, একবার যুবক নিচে পড়ে—অবশেষে যুবক দৈত্যকে নিচে ফেলে কিলিয়ে মেরে ফেলল।
কিন্তু সে বন এত গভীর যে, সেখানে রাজা বা তার উজির-নাজির কেউ যেতে পারবে না। মরা দৈত্যকে কাঁধে করে আনাও সম্ভব নয়।
সেই বনে এক রকম গাছ ছিল, যার পাতা বেশ বড় আর মসৃণ। যুবক সেই শুকনো পাতা কুড়িয়ে আঠা ও কাঁটা দিয়ে পরপর জুড়ে দুই হাত চওড়া ও পাঁচ-ছয় হাত লম্বা করল। বটগাছের একটা কাঁচা ঝুরি ভেঙে তাকে দাঁত দিয়ে চিবিয়ে তুলি তৈরি করল। তারপর দৈত্যের রক্তে সেই তুলি ডুবিয়ে সে আঁকল ঘটনাবহুল ছবি। বাড়ি থেকে নৌকায় করে আরব আসা ও বনে গিয়ে কিভাবে দৈত্য বধ করল—এই ছিল তার বিষয়বস্তু।
পটটির প্রথমে ও শেষে একটি করে দুটি কাঠি এঁটে এবং গাছের ছাল দিয়ে বেঁধে পটটি গুটিয়ে রাখল। তারপর রাজার নিকট গিয়ে বলল, "আমি দৈত্য মেরেছি।"
রাজা বললেন, "দৈত্য মেরেছ, তার প্রমাণ কী?"
যুবক বলল, "দৈত্য বনের গহিনে পড়ে আছে, আপনারা যেতে পারবেন না। দেখুন, আমি কিভাবে দৈত্য মেরেছি।" এই বলে সে পটটি খুলে নিচে দেওয়া গানটি গেয়ে শোনাল:
শুন শুন শুন রাজা শুন বিবরণ,
কিভাবেতে দৈত্য মারিলাম বলিব এখন।
তোমার দেশের লোকেরা সব বাঙলা মুলুক যায়,
ধান কেনে, পাট কেনে, নৌকাতে চাপায়।
তাদের মুখেতে শুনি দৈত্যটার কথা,
অত্যাচার শুনে মনে পাই বড় ব্যথা।
নৌকায় চাপিয়া আসি আপনার দেশে,
আপনারে বলি আমি সবই অবশেষে।
খুশী হয়ে তুমি রাজা দিলে মোরে ঠাঁই,
খাই-দাই, কুস্তি শিখি, কোনো ভয় নাই।
অবশেষে একদিন খাবার-দাবার লয়ে,
দৈত্যের কাছে যাই আমি মাথায় করে বয়ে।
দৈত্যের খাবার রাখি বটগাছ তলে,
ফল-মিষ্টি দেখে মুখ ভরে গেল জলে।
ফল খাই, মিষ্টি খাই, ডাকি দৈত্য বলে—
মাংস খাবার কালে দৈত্য এলো চলে।
দৈত্যের খাবার খাই, দৈত্য দেখে তাই,
ছুটিয়া আসিয়া মোরে মারিবারে চায়।
দৈত্যের সঙ্গে হয় তুমুল লড়াই,
লড়ায়ে লড়ায়ে বনের ভিতরেতে যাই।
একবার হারে দৈত্য, পরে আমি হারি,
বনের গহিনে তারে কিল-চড় মারি।
বুড়ো দৈত্য বল শেষ, হাঁপায় সদায়,
এক ঘুষি মারি তার নাকের ডগায়।
নাক কেটে লোহু ঝরে, আসে মোরে তেড়ে,
আর ঘুষি মারি তার বুকের উপরে।
কাঁটা বনে মাটি 'পরে চিত হয়ে পড়ে,
ভূমিকম্প হয় যেন সারা বন জুড়ে।
বুকের উপরি বসি ধরি টু'টি তার,
নাকে-মুখে বজ্র কিল মারি বারবার।
মরিল বিষম দৈত্য মোর কিল-চড়ে,
কেমনে দেখাব দৈত্য ভাবি বারে বারে।
তখনও গাছের পাতা আঠা কাঁটা দিয়ে,
জুড়িলাম পরপর লেখায় দাঁড়িয়ে।
দুই হাত চওড়া আর লম্বা হাত ছয়,
পরপর আঁকি ছবি শুন মহাশয়।
বটের ভাঙিয়া ঝুরি চিবাইয়া দাঁতে,
দৈত্যের রক্ত দিয়ে আঁকি ছবি পাতে।
এইভাবে মারি দৈত্য শুন মহাশয়,
চিত হয়ে আছে পড়ে, করহ প্রত্যয়।
নাকে-মুখে রক্ত ঝরে, বন লালে লাল,
গহীন বনেতে আছে, জ্বলিছে মশাল।
এইভাবে ছবি দেখে রাজা বুঝলেন যে, যুবক সত্যিই দৈত্য মেরেছে। তখন রাজা সেই যুবককে বহু টাকা পুরস্কার ও চিত্রকর উপাধি দান করলেন।
এই যুবক বাংলা মুলুকে ফিরে এলো ও পট আঁকা শুরু করল। তার ছেলেরা তার কাছে পট আঁকা শিখল। এই যুবকের ছেলের ছেলেরা ছড়িয়ে পড়ল দেশে বিদেশে। এই হলো পটুয়াদের পট আঁকার আদিকথা।
[ আমার দাদিমা (গুলনাহার বেগম, ভোলা জেলা) থেকে সংগ্রহ করা]
