এক দেশে ছিল এক বিরাট দরিয়া (সমুদ্র)। দরিয়ার এক কূল হতে অন্য কূল দেখা যায় না। দরিয়ার কূল যে কত দূর তা কেউ জানে না। এই দরিয়ার ধারে ছিল এক দেশ। সেই দেশে বাস করত এক সওদাগর। সওদাগরের ছিল বহু নৌকা, জাহাজ, লোক-লস্কর, মাঝি-মাল্লা। বহু নৌকা-জাহাজ সাজিয়ে পাঁচ বৎসর অন্তর সওদাগর দূর দূর দেশে বাণিজ্য করতে যেত। সওদাগর ছিল বিরাট ধনী। তার ধনাগারে সোনাদানা, হীরামতি বহুত মজুত ছিল। সওদাগরের পাঁচ ছেলে চার মেয়ে। এছাড়া সওদাগরের খুড়তুতো, মাসতুতো ভাই-ভগ্নী সবাই একসাথে এক অঙ্গনে বসবাস করত। সওদাগরের একটি ছোট মেয়ে ছিল, তার নাম পুন্কাবতী। ক্রমে ক্রমে তার ছেলেমেয়েরা বড় হলো। অন্য দেশের চার সওদাগরের মেয়ের সঙ্গে চার ছেলের বিয়ে দিল। ছোট ছেলের বিয়ে তখনও হয় নাই। মেয়েদেরও বিয়ে হয় নাই।
তার ছোট ছেলে ছিল যেমন বুদ্ধিমান, তেমনি স্বাস্থ্যবান। আর ছোট মেয়ে পুন্কাবতী যেমন সুন্দরী, তেমনি বুদ্ধিমতী। বাড়িতে অনেক অবিবাহিত (কুমারী) মেয়ে। ছোট ছেলে ঠিক করল, এই সব অবিবাহিত মেয়েদের একজনকে কৌশলে বিয়ে করবে, তবে নিজের বোনকে নয়।
দরিয়ার ধারে ছিল নানা ফলের বাগান। তখন আমের সময়। গাছে গাছে কাঁচা, ডাঁশানো আর আধপাকা আম। ছোট ছেলেটা একদিন এক আমগাছে উঠে একটা ডাঁশালো আম পাড়ল। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, "এই আমটা আমি আমাদের বাড়ীর তাকে রেখে দেব। যে মেয়ে এই আমটা খাবে, তাকে আমি বিয়ে করব।" তারপর চুপি চুপি আমটা নিয়ে বাড়ীর মধ্যে বারান্দার দেওয়ালের উপর একটা তাকে রেখে দিল।
কিছুক্ষণ পর, তার ছোট বোন পুন্কাবতী সেই দিকে যাচ্ছিল। তাকের মধ্যে সে একটা আম দেখতে পেল। তাছাড়া আমটা বেশ খুশবুও ছড়াচ্ছিল। পুন্কাবতী আমটা তাক হতে পেড়ে বেশ আরাম করে খেয়ে নিল।
বৈকালের দিকে এসে ছোট ছেলে আমটা দেখতে গেল, কিন্তু আমটা দেখতে পেল না। আমটা কে খেয়েছে, তা সে খোঁজ নিতে লাগল। প্রথমে সে বাপের খুড়তুতো, মাসতুতো মেয়েদের শুধাল। তারা বলল, "না, আম খাই নি।"
পুন্কাবতী বলল, "আমটা আমি খেয়েছি। কি সুন্দর আম! খেতে খুব ভাল লেগেছে। রসিয়ে রসিয়ে আমটা খেয়েছি।" এই কথা শুনে ছোট ছেলেটার মন খারাপ হয়ে গেল। তার নিজের ছোটবোন পুন্কাবতী আমটা খেয়েছে। তাকেই বিয়ে করতে হবে। ছোট ছেলে তার মাকে আম ও প্রতিজ্ঞার কথা বলল।
তাদের বংশে নিয়ম ছিল, যে যা প্রতিজ্ঞা করবে তা পালন করতে হবে, নাহলে বংশের অমঙ্গল। একে একে বাবা, দাদা, বৌদি সবাই এ কথা শুনল, এমনকি পুন্কাবতীও শুনল। ঠিক হলো পুন্কাবতীর সঙ্গে তার ছোট দাদার বিয়ে দেওয়া হবে। তারপর নৌকায় চাপিয়ে পুন্কাবতীকে দরিয়ায় বিসর্জন দেওয়া হবে।
তারপর একদিন শুভদিন দেখে পুন্কাবতীর সঙ্গে তার ছোট দাদার বিয়ে হলো। মালাবদল, মুখ দেখাদেখি হলো। তার ছোট দাদা ও স্বামীর অন্তরে পুন্কাবতীর বধূ-বেশী মুখ চিরতরে অঙ্কিত হয়ে গেল। এরপর পুন্কাকে বিসর্জন দেওয়ার পালা। দামি শাড়ী, ওড়না, সোনা-রূপা, হীরামতির গহনা ইত্যাদিতে সাজিয়ে একটা নৌকায় চাপান হলো। মাঝি-মাল্লাবিহীন নৌকা দরিয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হলো। দরিয়ার ধারে পুন্কার মা, বাবা, দাদা, বৌদি, দিদি ইত্যাদি চোখের জলে দাঁড়িয়ে থাকল। পুন্কার নৌকা মাঝ দরিয়া দিয়ে ভেসে যেতে লাগল। রূপবতী পুন্কা দরিয়ার উপর দিয়ে ভেসে যেতে লাগল।
এই দেখে পুন্কার দাদা বলল:
পুন্কাবতী, পুন্কাবতী, বোন আমার ঘরে ফিরে আয়। (তিনবার)
এই কথা শুনে পুন্কাবতী বলল:
ছিলে দাদা হলে ভাসুর, আর কি আমার ঘরে ফেরা যায়।
ছোট দাদার আম খেয়ে, তার বৌ হলাম, হায়রে মরি হায়।
পুন্কাবতীর ঘরে ফেরার আর তো উপায় নাই।
দাদারা: পুন্কাবতীর নৌকাখানি দূর দিয়ে যা। (তিনবার)
পুন্কার নৌকা আরও দূর দরিয়ার দিকে ভেসে যেতে লাগল।
এরপর পুন্কাবতীর দিদিরা বলল:
পুন্কাবতী, পুন্কাবতী বোন আমার ঘরে ফিরে আয়। (তিনবার)
এই কথা শুনে পুন্কাবতী উত্তর দিল:
ছিলে দিদি হলে ননদ, আর কি আমার ঘরে ফেরা যায়।
ছোট দাদার আম খেয়ে তার বৌ হলাম হায়রে মরি হায়।
পুন্কাবতীর ঘরে ফেরার আর তো উপায় নাই।
দিদিরা: পুন্কাবতীর নৌকাখানি দূর দিয়ে যা।
পুন্কাবতীর নৌকা দূর দিয়ে চলে গেল।
বৌদিরা এরপর বলল:
পুন্কাবতী, পুন্কাবতী, ননদ আমার ঘরে ফিরে আয়। (তিনবার)
পুন্কাবতী উত্তর দিল:
ছিলে ভাজ (দেবর-জায়া), হলে জা, আর কি আমার ঘরে ফেরা যায়।
ছোট দাদার আম খেয়ে তার বৌ হলাম হায়রে মরি হায়।
পুন্কাবতীর ঘরে ফেরার আর তো উপায় নাই।
বৌদিরা: পুন্কার নৌকাখানি দূর দিয়ে যা।
এরপর পুন্কার নৌকা আরও দূর দিয়ে চলে গেল।
বাপ ও মা এরপর পুন্কাকে বলল:
পুন্কাবতী, পুন্কাবতী, মা আমার ঘরে ফিরে আয়। (তিনবার)
পুন্কাবতী উত্তর দিল:
ছিলে বাপ, ছিলে মা, হলে শ্বশুর শাশুড়ী। আর কি আমার ঘরে ফেরা যায়।
ছোট দাদার আম খেয়ে তার বৌ হলাম হায়রে মরি হায়।
পুন্কাবতীর ঘরে ফেরার আর তো উপায় নাই।
বাপ ও মা: পুন্কাবতীর নৌকাখানি দূর দিয়ে যা।
আর পুন্কার নৌকা অনেক দূরে চলে গেল।
ছোট দাদা ও স্বামী:
পুন্কাবতী, পুন্কাবতী, বোন আমার ঘরে ফিরে আয়। (তিনবার)
পুন্কাবতী উত্তর দিল:
ছিলে দাদা হলে স্বামী, আর কি আমার ঘরে ফেরা যায়।
তোমার রাখা আম খেয়ে, বৌ হলাম হায়রে মরি হায়।
পুন্কাবতীর ঘরে ফেরার আর তো উপায় নাই।
ছোট দাদা ও স্বামী আবার ডাকল:
পুন্কাবতী, পুন্কাবতী, পুন্কাবতী, ঘরে ফিরে আয়। (তিনবার)
এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ে গেল পুন্কাবতীর বধূ-বেশী মুখ। পুন্কাবতী একথার কোনো উত্তর না দিয়ে নৌকা হতে হাত ইশারা করে স্বামীকে জানাল সে ফিরবে না।
স্বামী তখন বলল: পুন্কাবতীর নৌকাখানি ডুবে যা।
এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে পুন্কার নৌকাটি মাঝ দরিয়ায় ডুবে গেল। তীরে দাঁড়িয়ে পুন্কার মা, বাবা, দিদিরা ও স্বামী কাঁদতে লাগল। পুন্কাবতী যখন ডুবে গেল তখন সেখানে একটা শঙ্খচিল চক্রাকারে উড়তে লাগল।
নৌকাডুবির পর পুন্কাবতী দরিয়ার নিচের দিকে নামতে লাগল। সেখানে ছিল একটা বড় ঝিনুক। ঝিনুকটার ভিতরে কোনো মাংস ছিল না। তার একটা ডালা (খোলস) মাটি কাদার উপরে ছিল, আর একটা ডালা খোলা ছিল। পুন্কা সেই ঝিনুকের নিচের ডালায় শুয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ওপরের ডালাটা নীচে নেমে গেল। পুন্কা নিরাপদে সেই ঝিনুকের মধ্যে রইল। এরপর পুন্কার ঝিনুক দরিয়ার নীচ দিয়ে চলতে লাগল। দিন গেল, মাস গেল, বছর ফিরে এলো। পুন্কার ঝিনুক দরিয়া ছেড়ে একটা নদীর মোহনা দিয়ে নদীতে ঢুকল। এই নদীটা এসে দরিয়ায় পড়েছিল। পুন্কার ঝিনুক এলো এক ঘাটের কাছে। এ দিকটা ছিল পুন্কার বাপের বাড়ীর উল্টো দিকে। অর্থাৎ দরিয়ার উত্তর তীরে ছিল পুন্কার বাপের ও স্বামীর বাড়ী। দরিয়ার দক্ষিণ দিকে নদীর মধ্যে পুন্কার ঝিনুক রইল নদীর জলের নীচে।
এক গোয়ালার ছেলে। তার একশোটা গাই গরু আছে। সারাদিন গরু চরায় বাথানে, তারপর সকাল থাকতে দুধ দুয়ে (দোহন করে) মাথায় করে নদীপারের এক শহরে বিক্রি করতে যায়। দুধ নিয়ে নদী পার হতে গিয়ে তার পায়ে পুন্কার ঝিনুকটা ঠেকল। গোয়ালার ছেলে, ঝিনুকটা পায়ে করে একটু দূরে সরিয়ে দিল। এইভাবে পরপর দু'দিন ঝিনুকটা পায়ে লাগল। আর সে পায়ে করে দূরে সরিয়ে দিল। ঝিনুকটা ঠিক সেই জলপথের নীচে আবার চলে এলো। তৃতীয় দিন আবার গোয়ালার ছেলের পায়ে ঝিনুকটা লাগল। এবার সে ভাবল, "পায়ে কি লাগল?" কৌতূহল হলে হাতে করে তুলে দেখল, একটা বড় ঝিনুক। আর ঝিনুকটা দেখতে খুব সুন্দর। তখন সে ঝিনুকটা বাড়ী নিয়ে গেল আর, ধানের খামারের নীচে রেখে দিল।
গোয়ালার ছেলে রোজ দুধ বেচতে যায়। তারপর বাড়ী এসে কিছু খেয়ে গরু নিয়ে বাথানে যায়। গোয়ালার ছেলের বাড়ীতে মা, বাপ কেউ ছিল না। তারা মারা গেছে। সেও বিয়ে করে নি। তাই সে সব কাজ নিজে করে। ঘর, দোর, উঠান, গোয়াল ঘর পরিষ্কার, তারপর রান্না-বান্না করে।
গোয়ালা একদিন সন্ধ্যায় গরু নিয়ে বাড়ী এসে দেখল, ঘর-বাড়ী ঝকঝক করছে, সব কিছু কাজ কে যেন করে দিয়েছে। এমন কি ভাত তরকারীও রান্না করা আছে। গোয়ালার ছেলে ভেবে পায় না, কে এ কাজ করে? এদিকে গোয়ালার ছেলে চলে গেলে পুন্কা ঝিনুকের পেট হতে বার হয়ে সব কাজ করে, আর গোয়ালার ছেলের আসার সময় হলে ঝিনুকের মধ্যে ঢোকে। গোয়ালার ছেলে কিছুই জানতে পারে না। পাশের বাড়ী এক বুড়ী আছে, তার কেউ নাই। সে ব্যাপারটা কয়দিন দেখছে।
গোয়ালার ছেলে, সেদিন দুধ দুয়ে অন্য এক জনকে দিয়ে শহরে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে গোয়াল ঘরের মাচানে লুকিয়ে রইল। পুন্কাবতী ঝিনুকের ভিতর হতে বেরিয়ে সব কাজ করতে লাগল। গোয়ালার ছেলে মাচা হতে সব দেখতে লাগল। এরপর পুন্কা গোবর ফেলতে গোয়ালে ঢুকল। আর গোয়াল কাড়া (পরিষ্কার করা) শেষ হলে যেই বেরুতে যাবে অমনি গোয়ালার ছেলে তার শাড়ীর আঁচল চেপে ধরল। দু'জনের সঙ্গে দু'জনের দেখা হলো। গোয়ালার ছেলে বলল, "আমার কেউ নাই, তুমি আমাকে বিবাহ কর।"
পুন্কা বলল: "আমার একবার বিয়ে হয়েছে, আর তারা আমাকে বাড়ী হতে তাড়িয়ে দিয়েছে, আর আমার জীবন খুব দুঃখের, সব শুনে যদি বিবাহ করতে চাও তো কর, আমার কোনো আপত্তি নাই।" এই বলে পুন্কা তার জীবনী গোড়া হতে সব বলতে লাগল। গোয়ালার ছেলে ছাড়া এই কথা শুনতে লাগল আর দু'জন। একজন পাশের বাড়ীর বুড়ী। অন্য জন বাড়ীর মধ্যে নিমগাছের ডালে বসে থাকা একটা শঙ্খচিল। পুন্কাবতী বলল, গোয়ালার ছেলের বাড়ী আসা পর্য্যন্ত সব ঘটনা।
এই কথা শুনে গোয়ালার ছেলে বলল: "আমার জীবনের ঘটনা শোন। আমি তোমার ছোট দাদা ও স্বামী। তোমাকে নৌকায় চাপানোর পর সবশেষে তোমাকে বোন বলে ডাকার পর স্ত্রীরূপে ডেকেছিলাম। তারপর তোমার নৌকা ডুবে গেল। মনে খুব ব্যথা পেলাম। মনে মনে দুঃখ হলো এই ভেবে যে, কেন, আম নিয়ে প্রতিজ্ঞা করে তাকে আম রাখলাম। কেনই বা পুন্কা খেল, কেনই বা বিয়ে হলো, আর কেনই বা তাকে বিসর্জন দেওয়া হলো। এই সব ভাবতে ভাবতে ঠিক করলাম আর বাড়ীতে থাকব না।
তারপর একদিন গভীর রাতে দরিয়ার ধারে এলাম। আমি নিজে নৌকা চালান জানতাম। একটা ভাল নৌকা নিয়ে পাড়ি দিলাম অনিশ্চিতের পথে। যেই নৌকা ছেড়েছি, অমনি এক শঙ্খচিল উড়ে এসে নৌকার মাস্তুলে বসল। নৌকা চালাতে লাগলাম নীচের দিকে। দশ বারো দিন নৌকা চালানোর পর দেখলাম একটা নদী এসে পড়েছে দরিয়াতে। নৌকা ঢুকিয়ে দিলাম মোহনার ভিতর দিয়ে। নদীপথে অনেক দূরে এসে পড়লাম। নৌকার মধ্যে যে খাবার রেখেছিলাম তা শেষ হয়ে গেছে। নদীর তীরে দেখলাম এক গোয়ালা অনেকগুলি গাভী চরাচ্ছে। নৌকা নদীর ধারে লাগিয়ে সেই গোয়ালার নিকট এসে কিছু খাবার চাইলাম। সে আমাকে বাড়ী নিয়ে গেল, আর দুধ, ভাত খাওয়ালো। গোয়ালার কেহ ছিল না। আমি তার নিকট তার পুত্রের মত থাকলাম। সেও আমাকে তার পোষ্য পুত্র নিল। শঙ্খচিলটাও এসে পাশে উড়তে লাগল। শঙ্খচিলটা সব সময় নৌকাতে থাকত, আর আমি মাঠে থাকলে মাথার উপর উড়ত। তারপর কয়েক মাস বাদ গোয়ালা আর তার স্ত্রী মারা গেল। আমি আর দেশে না ফিরে এখানেই থেকে গেলাম। তারপর এই তোমার সাথে দেখা। যাক আমরা স্বামী-স্ত্রী হয়ে এখানেই থাকবো।"
এই কথা যেই বলা হলো তখন পাশের বাড়ীর বুড়ী বলতে লাগল, "তোমাদের গল্প এখনও শেষ হয় নাই। তোমাদের কথা আমিও কিছু জানি।" এই বলে সেই বুড়ী বলতে লাগল:
"আমি ছিলাম দাইমা। থাকতাম তোমাদের দেশে। আমার মা এবং আমি তোমাদের ভাই বোনদের প্রসব করিয়েছি। পুন্কা ছিল সবার ছোট। পুন্কা যখন প্রসব হয় তখন সেই রাতে সব সময় তোমার মায়ের নিকট আমি ছিলাম। দুপুর রাতে তোমার মায়ের বেদনা উঠল। একটা মরা কন্যা প্রসব করল তোমার মা। আমি তখন মৃত সন্তানটা আর রক্ত মাখা কাপড়ের টুকরো ইত্যাদি হাঁড়িতে ভরে নিকটবর্তী আঁতুর আড়ায় ঝুল বাড়াতে গিয়েছি, এমন সময় দেখি পাশের পুঁইশাকের জমিতে একটা সুন্দরী সদ্যো-জাত কন্যা পড়ে আছে। হাতে নিয়ে দেখলাম সে বেঁচে আছে। তাকে তাড়াতাড়ি কোলে তুলে নিয়ে দ্রুত চলে এলাম তোমার মায়ের নিকটে। তোমার মা তখনও অজ্ঞান হয়ে আছে। মেয়েটি রেখে দিলাম তোমার মায়ের পাশে। তোমার মা জ্ঞান ফিরে পেল পুন্কাকে পেয়ে। আমি পুঁইশাকের ক্ষেতে ওকে পেয়েছিলাম তাই পুন্কাবতী বলে ডাকতাম। এইভাবে পুন্কা বড় হতে লাগল।
কয়েক বৎসর পর এক সওদাগর এলো অনেক নৌকা নিয়ে তোমাদের বাড়ী। সেখানে আমাদের জাতের একটা লোক গান গাইত ভাল। তার সঙ্গে নৌকায় সেই লোকটার এই গাঁয়ে বাড়ী। সে তোমাদের কথা শুনে তাই সত্যি কথা বলল। আমার শরীরের চেপে এই দেশে এলাম। অনেকদিন মরে গেছে। এতদিনে প্রকাশ করলাম। তোমরা সংসারী হও। তোমাদের তো বিয়ে হয়েই গেছে। পুন্কা তোমার সহোদরা নয়।"
বুড়ীর কথা যেই শেষ হলো তখন নিমগাছ হতে আধখানা মানুষ আধখানা শঙ্খচিল একজন বলতে লাগল, "পুন্কাবতীর গল্প এখানেই শেষ নয় আরও আছে।" তিনজনে গাছের দিকে তাকিয়ে আধা মানুষ, আধা শঙ্খচিল দেখে গোয়ালার ছেলে তাকে গাছ হতে নামিয়ে আনল।
সে বলল: "আমি এই দেশের রাজার খাস চাকর ছিলাম। সব সময় রাজার পাশে থাকতাম। রাজা আমাকে ভালবাসতেন। রাজার ছিল এক ছোট ভাই আর রাণী। তাদের কোনো সন্তান হয় নি। রাজা তাকে খুব ভাল বাসতেন। সে ছিল রাজার ধনাগারের কর্তা। রাজা মারা গেলে সেই রাজা হবে। কারণ রাজার কোনো সন্তান হয় নি, কিন্তু কয়েক বৎসর পর রাণী গর্ভবতী হলো। তখন ধনপতির খুব দুঃখ হলো। তার ভাগ্যে আর রাজা হওয়া হবে না। সে এক জাদুকরের কাছে জাদুবিদ্যা শিখেছিল। জাদুবিদ্যার বলে সে মানুষকে শঙ্খচিল করতে পারত, কিন্তু ফিরিয়ে মানুষ করতে পারত না। তাছাড়া তার গুরুর আদেশ ছিল, নিজ বংশের সঙ্গে সম্বন্ধ যুক্ত কোনো ব্যক্তিকে এই জাদু প্রয়োগ করলে তা খাটবে না।
এদিকে রাণী এক সুন্দরী কন্যা প্রসব করল কিছুদিন পর। সেদিন অন্য একজনের একটি মরা কন্যা হয়েছিল। সেটা কুড়িয়ে এনে গোপনে রাণীর ঘরে মরা কন্যা রেখে রাণীর কন্যাকে নিয়ে গেল। রাণী ঘুমিয়ে ছিল। কিছুই জানতে পারল না। তারপর মন্ত্রবলে আমাকে শঙ্খচিল করে দিল ও আমার পায়ে মেয়েটিকে বেঁধে আমাকে অনেক দূরে ছেড়ে দিল। আমি মেয়েটিকে উড়িয়ে এনে দরিয়া পার করে পুঁইশাকের ক্ষেতে রেখে দিলাম ও গাছের ডালে বসে থাকলাম। রাতেই এই দাই মা মেয়েটিকে নিয়ে গেল। যাক এই ভাল কাজ করার জন্য বনের বৃক্ষ দেবতা আমাকে বলল, 'যে মেয়েটিকে তুই বাঁচালি তার জীবন কথা শুনলে তুই মানুষ হবি।'
তাই আমি শঙ্খচিল হয়ে ঐ দেশে থাকতাম। তারপর মেয়েটির বিয়ে হলো, নৌকা করে বিসর্জন দিল। মনে মনে দুঃখ পেলাম। চক্রাকারে উড়লাম। ভাসমান পেলে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যেতাম। কিন্তু দেখলাম মেয়েটি ডুবে গেছে। ভাবলাম মেয়েটির স্বামীই আমার ভরসা। যদি কোনোদিন সে এইসব কথা বলে, তাই তাকে সব সময় চোখে চোখে রাখতাম। এক রাতে সে নৌকা নিয়ে পালাচ্ছে দেখলাম। আমি উড়ে এসে নৌকার মাস্তুলে বসলাম। কারণ এই লোকটি আমার শেষ আশ্রয়। এইভাবে এসে এখানে থামল। এক গোয়ালার আশ্রয়ে থাকল। তারপর ঝিনুক নিয়ে এলো বাড়ীতে, তারপর দেখলাম বাড়ীতে সেই মেয়েটি কাজ করছে। তারপর আজ সব কথা এই গাছে বসে শুনতে শুনতে আমি আবার পূর্বরূপ ফিরে পেয়েছি।"
পুন্কাবতী বলল: "তা'হলে আমি এই দেশের রাজার মেয়ে?"
যখন শঙ্খচিলের গল্প শেষ হলো তখন নদীর ঘাটে শোনা গেল নানা বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি ও গান। শোনা গেল, দেশের রাজা প্রমোদ ভ্রমণে এসেছেন নদীপথে। রাজা এখানে নেমে আহারাদি করবেন। শঙ্খচিল ছুটে নদীর ঘাটে গেল। রাজা অনেকদিন পর তার বিশ্বাসী চাকরকে দেখে খুশী হলো। রাজাকে শঙ্খচিল সব কথা বলল। রাজা শঙ্খচিলকে বলল যে, তার ছোট ভাই ধনপতি মারা গিয়েছে। তার শোক ভোলার জন্য তিনি নৌকা ভ্রমণে বেরিয়েছেন। রাজা সব শুনে মেয়ে জামাইকে নিয়ে এলেন নদীর ঘাটে।
ইতিমধ্যে পুন্কার পালক পিতা বণিক বাণিজ্য করে ফিরে আসছিল। রাজার সঙ্গে ছিল তার বন্ধুত্ব। সে পুন্কাবতী ও তার পুত্রকে দেখল। সব শুনল। এইভাবে ঘটল মিলন। দাইমা নবজাত কন্যাকে বাঁচিয়েছিল, তাই দাইমাকে একটা গ্রাম দান করলেন রাজা। এই গ্রামটা সেই গোয়ালা যেখানে বাস করত। দাইমার নামে গ্রামটার নাম হলো দাইমার গ্রাম— দাইগ্রাম।
[আমার দাদিমা (গুলনাহার বেগম, ভোলা জেলা) থেকে সংগ্রহ করা]
