কাঞ্চনগড় নামে ছিল এক রাজ্য। এই রাজ্যের রাজা খুব সুখী। রাজার সাত রাণী। পুত্র জন্ম গ্রহণ করেছিল। একটি পুত্র রাজা ও সাত রাণীর চোখের মণি। রাজ্যের প্রজাকুল ও রাজ সভাসদ, মন্ত্রী, পাত্র-মিত্র সকলের প্রিয় এই রাজকুমার। সকলের আদর যত্নে রাজপুত্র কিশোর হতে ক্রমে যৌবনে পদার্পণ করল। রাজপুত্র কি পড়াশুনায়, কি অস্ত্রবিদ্যায়, কি শিকার সবকিছুতে পটু।
একদিন ভ্রমণ শেষে রোজকারমতন রাজকুমার বিছানায় গা এলিয়ে দিল। সেদিন রাতে রাজকুমার এক বিচিত্র স্বপ্ন দেখল। রাজপুত্র যেন এক অজানা গভীর বনে শিকারে গিয়েছে। তার সামনে এক বন্য বরাহ। রাজকুমারের শিকারীরূপ দেখে প্রাণের ভয়ে বন্য বরাহ ছুটে চলেছে। রাজকুমারও তার পিছু পিছু ঘোড়া ছোটাচ্ছে। এই ভাবে সে তার লোকজন ফেলে ছুটে চলেছে।
ক্রমে চোখের সম্মুখ হতে বন্য বরাহ বনে কোথায় হারিয়ে গেল। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, রাত্রি আসন্ন। রাত কাটানোর জন্য এক বট গাছের নীচে ঘোড়াবেঁধে গাছে উঠে বসে থাকল। সকাল হলে সে ঘোড়া নিয়ে নিজের সঙ্গীদের খুঁজতে লাগল। খুঁজতে খুঁজতে সে পেল এক বন্য পথ।
বন্য পথ দিয়ে ছুটতে ছুটতে সে অনেক দূরে পাহাড় ঘেরা এক পুরী দেখতে পেল। পাহাড় দিয়ে ঘেরা সুরক্ষিত পুরী। এদিকে রাজকুমার ঘুরে ঘুরে শ্রান্ত, ক্লান্ত, পিপাসিত হয়ে পড়েছে। তাই সে পুরীর দ্বারদেশে গিয়ে হাজির। দেখলো পুরীর দ্বারে অস্ত্রহাতে দুই জন দ্বারী বসে আছে। সে গিয়ে তাদের নিকট পিপাসার জল চাইল। দ্বারী ভিতরে গিয়ে খবর দিল।
কিছুক্ষণ পরে এক সুন্দরী রূপবতী কন্যা দ্বারে এসে হাজির। তার হাতে জলপাত্র ও খাবার। তার নিকট হতে জল ও মিষ্টান্ন খেয়ে রাজপুত্র সুস্থ হলো। দ্বারীকে জিজ্ঞাস করে জানল, যে এই রাজ্যের নাম পাহাড়পুর। জলদানী এই কন্যা, পাহাড়পুরের রাজকুমারী, এখনও অবিবাহিতা। এই পর্যন্ত স্বপ্ন দেখে রাজকুমারের ঘুম ভেঙ্গে গেল।
মা বাবাকে সে জানাল যে পাহাড়পুরের এই জলদানী রাজ-কন্যার সঙ্গে তার বিবাহ দিতে হবে। রাজা মন্ত্রীদের সঙ্গে যুক্তি পরামর্শ করল।
মন্ত্রী বল্ল: স্বপ্ন, স্বপ্ন। স্বপ্ন কি কখন সত্য হয়? আমরা অন্য কোন রাজ্যের সুন্দরী রাজকন্যার সন্ধান করে রাজপুত্রের বিবাহ দিব।
রাজা বললেন: এই কথা ঠিক।
কারণ অনেক খোঁজ খবর করে পাহাড়পুরের রাজ্যের কোন সন্ধান পাওয়া যায় নি। সব শুনে রাজপুত্র, এ বিবাহে রাজী হলো না। সে পাহাড়পুরের জলদানী রাজকন্যা ছাড়া অন্য কোন বাজার কন্যাকে বিবাহ করবে না।
এই ভাবে দিন যায়। রাজপুত্র থাকে মনের দুঃখে। তার চিন্তা সেই জলদানী রাজকন্য। একদিন রাজপুত্র বন্ধু, বান্ধব, লোক লস্কর নিয়ে বনে শিঙ্কার করতে গেল। রাজপুরী ছেড়ে এক গভীর বনভূমির প্রান্তে তারা হাজির হলো। সেখানে গাড়া হলো আস্তানা। সকালে লোক-লস্কর নিয়ে রাজপুত্র বনে প্রবেশ করল।
দুপুরের সময় রাজপুত্র এক বন্য বরাহ দেখতে পেল। ঐ বরাহটি ধরার জন্য লস্করেরা ঘিরে ফেলল। কিন্তু লাফ মেরে বরাহ পালিয়ে গেল। বরাহ ধরার জন্য রাজপুত্র বন্য বরাহের পিছনে পিছনে ছুটতে লাগল। কিন্তু ধরি ধরি করে বরাহ ধরতে পারল না। তারপর এক সময়ে বরাহ বনে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
রাজপুত্র লোক লস্কর ফেলে অনেক দূরে চলে গেছে। সূর্য্য ডুবু ডুবু। বনে নানা বন্য জন্তুর আবাস। তখন আর আস্তানায় ফেরা সম্ভব নয়। রাত কাটানোর জন্য ফাঁকা একটি স্থানে সে এক বট গাছ দেখতে পেল। গাছের নীচে ঘোড়া বেঁধে বটগাছে উঠে একটি ভাল ডালে বসে রাত কাটিয়ে দিল।
সকাল হলে সে সঙ্গীদের খোঁজে ঘোড়ার পিঠে চেপে খুঁজতে লাগল। কিন্তু বন আর শেষ হয় না। এদিকে বেলা বাড়তে লাগল। অবশেষে দুপুরের সময় রাজপুত্র একটা বনপথের সন্ধান পেল। সেই বনপথে ঘোড়া ছুটিয়ে চলল।
কিছু দূর গিয়ে সে দেখল পাহাড়-ঘেরা রক্ষিত এক পুরী। এদিকে রাজপুত্র শ্রান্ত, পিপাসিত ও ক্ষুধার্ত। ঘোড়া ছুটিয়ে সে পাহাড়পরীর দ্বারে গিয়ে হাজির হলো। দেখল, দ্বারে দু'জন অস্ত্রধারী দ্বারাঁ। তাদের নিকট সে পিপাসার জল চাইল। এক দ্বারী গিয়ে ভিতরে খবর দিল। একজন পরমা সুন্দরী কন্যা এসে জল ও খাবার দিয়ে রাজপুত্রের প্রাণ রক্ষা করল। রাজপুত্র যেমন যেমন স্বপ্নে দেখেছিল, ঠিক তেমনই ঘটে গেল। এমন কি স্বপ্নে দেখা রাজ কন্যার মুখের সঙ্গে এই কন্যার মুখের সম্পূর্ণ মিল দেখতে পেল। খোজ নিয়ে জানল যে এই রাজ কন্যার বিবাহ হয়নি। আবার এই রাজোর নামও পাহাড়পুর।
এই রাজকন্যার বিবাহ সম্পর্কে একটা পণ আছে। রাজবাড়ীর নিকটে একটা কুয়ো আছে। এই কুয়ো যে সোনার গহনা দিয়ে ভরাট করতে পারবে, তাকেই রাজকন্যা বিবাহ করবে। অনেক রাজপুত্র এসেছে কেহই সোনাদানা দিয়ে কুয়ো ভরাট করতে পারে নি।
সেদিন রাজপুত্র কুয়োটি ভাল করে দেখল। রাত্রে সে কুয়োর পাশে একটা বট গাছের ডালে ঘোড়া বেঁধে নীচে বসে থাকলো। দুই জন পরী উড়তে উড়তে এসে সেই গাছে বসে পরস্পর বলাবলি করতে লাগল যে, এই কুয়োটা মোটেই গভীর নয়। এর মধ্যে অনেক গুলো ভূত আছে। তাদের জন্য সোনা-দানা দেখা যায় না! এই কুয়োর গায়ে আয়না বসিয়ে দিয়ে কুয়োতে অল্প কিছু সোনা ফেলিয়ে দিলেই কুয়ো ভর্তি হয়ে যাবে।
কারণ পূর্ব হতে কুয়ো ভর্তি হয়ে আছে। রাজপুত্র সব শুনে কয়েটা আয়না কিনে এনে কুয়োটার গায়ে লাগিয়ে দিল। তারপর নগর হতে কিছু সোনা কিনে এনে কুয়োয় ফেলে দিল। কুয়ো সোনায় ভর্তি হয়ে গেল। তখন কন্যা তাকে বিবাহ করল।
বিবাহের পর কন্যাকে নিয়ে রাজপুত্র নিজের রাজ্যে ফিরে চলল। কিছুদূর আসার পর সাতজন ডাকাত তাদের ঘিরে ফেলল। রাজকন্যা তার স্বামীকে বলল, এরা বড় ডাকাত, এদের সঙ্গে পারবে না। কৌশলে এদের জয় করতে হবে। রাজকন্যা ডাকাতদের বলল, তোমাদের মধ্যে যে আমাকে পেতে চাও, সে চোখ বন্ধ করে আমার দিকে ছুটে এসো। সাত ডাকাত চোখ বন্ধ করে ছুটতেই, নিমিষে রাজকন্যা রাজপত্রের ঘোড়ায় চড়ে ছুটে চলে গেল।
সাত ডাকাতের হাত হতে রক্ষা পেয়ে তারা অন্য এক রাজ্যে এলো। তারা তখন খুবই ক্ষুধার্ত। রাজকন্যা তার হাতের একটা দামি আংটি খুলে স্বামীর হাতে দিয়ে সেটি বাজারে বিক্রয় করে কিছু খাবার আনতে বলল। রাজপুত্র আংটি নিয়ে একজন স্যাকরার দোকানে গেল। আংটি দেখে স্যাকরা বুঝল খুব দামী আংটি। স্যাকরা বলল: কেন এই আংটি বিক্রয় করবে? রাজপুত্র তখন নিজের স্ত্রী নিয়ে গৃহ গমন ও পথে ডাকাতদের আক্রমণ এবং বর্তমানে ক্ষুধার্ত হওয়ার কথা বলল।
স্যাকরা ছিল লোভী ও চতুর। কোথায় রাজকন্যা আছে জেনে নিয়ে, সে রাজপুত্রকে একটু অপেক্ষা করতে বলল। তারপর অন্য পথে একদল লোক দিয়ে রাজকন্যাকে বন্দি করে নিয়ে এলো। রাজপুত্রকে তারপর আংটির দাম দিল। খাবার নিয়ে এসে দেখে রাজকন্যা নাই। সে তখন ঘোড়াটা একস্থানে বেঁধে সেখানেই ঘুরে বেড়াতে লাগল।
একদিন রাজকন্যা দেখল যে নিচের রাস্তা দিয়ে বিষণ্ণ মনে রাজপত্র যাচ্ছে। তখন বন্দী রাজকন্যা জানালা পথে তাকে বলল, আগামী কাল রাতে স্যাকরার বাড়ীতে যাত্রাগান হবে। তুমি ঘোড়া নিয়ে একটু রাতে ঠিক জানালার নীচে থাকবে, আমি জানালা হতে লাফিয়ে ঘোড়ার পিঠে পড়ব।
সন্ধ্যার সময় রাজপুত্র ঘোড়াটি স্যাকরার বাড়ীর জানালার নীচে রাখল। আর ভাবল এখন একটু দেরী আছে, এই অবসরে একটু যাত্রা গান শোনা যাক্। তাই ঘোড়া রেখে ফাত্রা গান শুনতে গেল। ক্রমে সে গানে মসগুল হয়ে পড়ল।
এদিকে একজন পাহারাওয়ালা পাহারা দিতে এসে পথের পাশে একটা ঘোড়া দেখে তার লাগাম ধরে পিঠে যেই চেপেছে, অমনি রাজকন্য ঝাঁপ দিয়ে পাহারাওয়ালাকে স্বামী মনে করে, ঘোড়ার পিঠে চেপে ঘোড়া ছুটিয়ে দিতে বলল।
পাহারাওয়ালা এক বনে এসে হাজির হলো। এক অপূর্ব সুন্দরী কন্যা দেখে তার মাথা ঘুরে গেল। সে এই কন্যাকে বিবাহ করবে বলে ঠিক করল। বনের মধ্যে রাজকন্যা এসে বুঝল তার ভুল হয়ে গেছে। কোন কথা না বলে সে এক গাছের নীচে ঘোড়া বাঁধতে বলল পাহারা-ওয়ালাকে। পাহারাওয়ালা সেখানে ঘোড়া বাঁধল। তারপর গাছতলায় রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করতে লাগল।
গাছতলে দু'জনে শুয়ে পড়ল। মনের আনন্দে পাহারাওয়ালা কন্যার পাশে ঘুমিয়ে পড়ল। রাজকন্যা মনের দুঃখে জেগে রইল। সেই গাছে ডাহুচ, ডাহুকী দুই পাখী ছিল। তারা বলাবলি করতে লাগল যে, আমাদের বিষ্ঠার টিপ যদি কেহ কপালে পরে, তাহলে নারী পুরুষ হয়ে যাবে, আর পুরুষ নারী হবে। আবার টিপ খুলে দিলে যা ছিল তাই হবে।
পাখী দুটি যেখানে বসে ছিল, তার নীচে ছিল তাদের বিষ্ঠা। রাজকন্য। সেই বিষ্ঠার টিপ কপালে দিয়ে পুরুষ হয়ে গেল। পাহারাওয়ালা উঠে দেখে সুন্দরী নাই, কোথায় গেল! সামনে সে পুরুষ বেশী রাজপুত্রীকে জিজ্ঞাসা করল, সে একটা সুন্দরী মেয়ে দেখেছে কি না? যুবকবেশী রাজপুত্রী বলল যে, সে কোন মেয়ে দেখে নাই। পাহারাওয়ালা হায় হায় করতে করতে বনে বনে সুন্দরীকে খুঁজতে লাগল।
যুবক বেশী রাজপুত্রী, সেই দেশের দরবারে গিয়ে নিজের যোগ্যতা দেখিয়ে একটা চাকরী নিল। সেদেশ শাসন করতো, সে দেশের রাণী। পিতার মৃত্যুর পর সে রাণী হয়েছে। যুবকের গুণে মুগ্ধ হয়ে রাণী তাকে বিবাহ করল। এই ভাবে কয়েক মাসের মধ্যে সে, সেই রাজ্যের সর্বময় কর্তা হয়ে গেল।
তারপর সাত চোর, স্যাকরা, পাহারাওয়ালা ও বিদেশী রাজপুত্রকে ধরে আনল বিচারের জন্য। সাত চোরের, স্যাকরা ও পাহারাওয়ালাকে ফাঁসি দিল। তারপর রাজকুমারকে নিয়ে অন্দরের ভিতরে গেল। তারপর নিজের কপালের টিপ খুলে ফেল্ল। রাজকুমার নিজের স্ত্রীকে চিনতে পারল। তারপর স্বামীর সঙ্গে এই রাণীর বিবাহ দিল। এই ভাবে তিনটি রাজ্য এক হয়ে গেল।
[মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার, কাগ্রাম নিবাসী শ্রীঅসীমকুমার মুখোপাধ্যায়ের নিকট হইতে সংগৃহীত। তিনি তাঁর মা শ্রীমতা জ্যোতির্ময়ী মুখোপাধ্যায়ের নিকট শুনেছিলেন।]
