জীরেবতী । বাংলা রূপকথার গল্প

ছোটদের রূপকথার গল্প

এক গাঁয়ের ধারে ছিল এক নদী। সেই গাঁয়ে বাস করতো অনেক কুমোর। এই কুমোররা মাটির হাঁড়ি, কলসী, সরা ইত্যাদি তৈরী করে গাঁয়ে গাঁয়ে বিক্রী করতো। এই কুমোরদের মধ্যে এক ঘর ছিল, তারা স্বামী-স্ত্রী। তাদের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। সব মেয়ে। এক এক করে তাদের ছয় কন্যা হলো। এই দেখে কুমোর রেগে গেল। কিন্তু এই কুমোরের স্ত্রী ও মেয়েরা কুমোরকে হাঁড়ি তৈরী কাজে সাহায্য করতো।

কিছু দিন পর কুমোর গিন্নি আবার গর্ভবতী হলো। কুমোর বললো, এবার যদি মেয়ে হয়, তাহলে তোকে মেরে ফেলব। সব কুমোরের বেটা ছেলে আছে। তারা সব হাঁড়ি গড়ার কাজ করে। আর আমার সব মেয়ে। মাঠ হতে মুনিষ করে হাঁড়ি গড়ার মাটি আনতে হয়। বেটা ছেলে থাকলে কত কাজ হতো। এই কথা শুনে কুমোরনী ভয়ে ভয়ে থাকে। কি জানি, মেয়ে যদি হয়, তাহলে তো মরণ অনিবার্য কুমোরের হাতে।

যত প্রসবের সময় কাছে আসে কুমোরনী তত গাঁয়ে গাঁয়ে হাঁড়ি কুড়ি বেচতে যায়। একদিন কুমোরনী বড় বড় হাঁড়ি কড়াই বেচতে গিয়েছে। নদীর ধারে ধারে পায়ে চলা পথ। পথের দু'ধারে জীরের ভুঁই। ছুঁয়ে ছুঁয়ে বন লেগে গেছে জীরে গাছের। জীরে গাছের কাঁচা গন্ধে ভুইগুলো মৌ মৌ করছে।

সেইখানে কুমোরনীর প্রসব বেদনা উঠল। কুমোরনী ফুলের মত সুন্দর এক কন্যা প্রসব করল। যেমন নাক, তেমনি চোখ, তেমনি মুখশ্রী, তেমনি দুধে আলতায় রং। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু এই কন্যা নিয়ে গেলে কুমোর তাকে মেরে ফেলবে। তাই মনের দুঃখে মেয়েকে হাঁড়িতে ভরে জীরের ভুঁইয়ের মাঝে রেখে চলে এলো।

কুমোরকে বলে আমাদের একটা সুন্দর ছেলে হয়েছিল, তবে পেটে মরা। এই বলে কুমোরনী তার মেয়ের জন্য কাঁদতে লাগল। কুমোর বলে, কি আর হবে, কপাল।

কিছুক্ষণ পর সেই পথ দিয়ে ভিক্ষা করে এক ফকির ফিরে যাচ্ছিল নিজের দূর গাঁয়ে। সেইখানে এসে সে এক শিশুর কান্না শুনতে পেল। খুঁজতে খুঁজতে সে জীরের ভুঁই হতে কন্যাটিকে কোলে তুলে নিল। তার পরে তাকে তার বাড়ী নিয়ে গেল।

কন্যা পেয়ে ফকির খুব আনন্দিত। পাড়া প্রতিবেশীর নিকট হতে তেল চেয়ে এনে, দুধ চেয়ে এনে কন্যা মানুষ করতে লাগল। ফকির ভিক্ষায় গেলে তার ঝুলি ভরে যেত। এই ভাবে দিন যায়। জীরের ভুঁয়ে মেয়েটি কুড়িয়ে পেয়েছিল বলে ফকির তার নাম দিয়েছিল জীরেবতী।

দেখতে দেখতে জীরেবতী আঠারো বছরের হলো। তার রূপে জগত আলো। মাথায় এক রাশি চুল। চুল পায়ের গোঁড়ালি পর্যন্ত লম্বা। চুল ভিজিয়ে গা ধুলে শীতল পাটি বিছিয়ে আঙিনায় বসে রোদে চুল শুখাতে হয়। এমনিভাবে দিন যায়।

একদিন দেশের রাজা দেশ দেখার জন্য বেরিয়েছে। পালকি চেপে রাজা চলেছে। আটজন বেহারা আর লোকজন চলেছে। জীরেবতি যে গাঁয়ে থাকে সেই গাঁয়ের পাশ দিয়ে পথ। পথের ধারে গাঁয়ের শেষে ফকিরের বাড়ী। পথের ধারে পালকি থামিয়ে রাজা তার লোকজনদের সেইখানে রান্না করতে বলল। 

একজন বেহারা আগুন আনতে গেল। পথের পাশে ফকিরের বাড়ী। উঠানে শীতলপাটি বিছিয়ে তার উপর বসে চুল ছড়িয়ে দিয়ে জীরেবতি চুল শুকাচ্ছে। সে বসে আছে দরজার দিকে পিছন ফিরে। কাছেই ফকিরের বাড়ী। রাজার বেহারা ফকিরের বাড়ী ঢুকেছে আগুনের জন্য। আর জীরেবতীর রূপ দেখে অজ্ঞান হয়ে গেছে। তার দেরী দেখে আর একজন গিয়েছে, সেও অজ্ঞান। এমনি করে রাজার সব লোক অজ্ঞান হয়ে ফকিরের বাড়ীতে পড়ে আছে।

সব শেষে রাজা তার লোকেদের সন্ধান নিতে ফকিরের বাড়ী এলো। জীরেবতীর রূপ দেখে সেও অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল। কিছুক্ষণ পর ফকির বাড়ী এলো। দেখল তার বাড়ীতে বহু লোক অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। জীরেবতীকে শুধাল, কি ব্যাপার?  জীরেবতী বলল, ওরা এলো আর অজ্ঞান হয়ে গেল! ফকির পানি ছিটিয়ে সকলের জ্ঞান ফিরিয়ে আনল। লোকেরা আগুন নিয়ে রান্না করতে বসল। রাজা ফকিরের সঙ্গে কথা বলতে লাগল।

রাজা ফকীরকে বলল, আমি এই দেশে রাজা। এই মেয়ে তোমার কে?

ফকির: রাজামশাই এ আমার মেয়ে।

রাজা: আমি তোমার এই মেয়েকে বিয়ে করতে চাই। তুমি কী বল?

ফকির: মহারাজ! আমি কিছুই চাই না, আমার মত ফকিরের মেয়েকে বিয়ে করবেন, এটা আমার সৌভাগ্য। তবে মহারাজ আমাকে একটা তিনতলা পাকা বাড়ী করে দিন।

রাজা বললে, তাই হবে। পরদিন ফকিরের ভিটেতে দালান বাড়ীর ভিত খুঁড়ে দালান করা শুরু হলো। কিছুদিন পর তিনতল। দালান তৈরী হলো। ধূমধাম করে রাজার সঙ্গে জীরেবতীর বিয়ে হলো।

রাজা জীরেবতীকে নিয়ে যাচ্ছে। ফকির প্রথমে একতলার বারান্দায় উঠে চলন্ত  জীরেবতীকে দেখতে লাগল। তারপর দোতলায় উঠল। তারপর তিনতলায়। তারপর আর  জীরেবতীকে দেখতে পায় না। সে লাফ দিয়ে তার প্রিয় পালিতা কন্যাকে দেখতে লাগল। এই ভাবে লাফ দিতে গিয়ে তিনতলার ছাদ হতে পড়ে ফকির মরে গেল। গাঁয়ের লোক ফকিরকে সেই বাড়ীর উঠানেই কবর দিল।

জীরেবতীকে বিয়ে করার পর রাজা তার জন্য আলাদা একটা মহল বানিয়ে দিল। রাজা  জীরেবতীকে চোখের আড়াল করে না। এই রাজার আরও ছয়টা রাণী ছিল। এই ছয় রাণী এক সঙ্গে পুরোনো মহলে থাকে। এই রাজার ছিল এক ছোট বোন। সে রাজার বড় আদরের বোন। তার কোলে ছিল এক শিশু। এই ভাগনেটিকে রাজা খুব ভালবাসে।

এক দিন ঠিক হলো বোনের ছেলের মুখে ভাত দেওয়া হবে। রাজবাড়ীতে চলছে খব ধূমধাম। ছোটরাণী  জীরেবতী এই উৎসবে পুরোণো মহলে এসেছে। এখানে থাকে তার ছয় সতীন। জীরেবতীর রূপ দেখে ও তার প্রতি রাজার ভালবাসা দেখে সতীনদের খুব হিংসা হলো। ছয় সতীনে ঠিক করল আজ জীরেবতীকে তারা জব্দ করবে।

রাজার আদরের বোনের একমাত্র শিশুপুত্র তখন নির্জন ঘরে বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। ছয় জন চুপি চুপি গিয়ে ছেলেটির একটি আঙ্গুল কেটে নিল। তারপর সেই আঙ্গুলটি নিয়ে  জীরেবতীর কাছে গেল। জীরেবর্তী তখন একটা ঘরে ঘুমিয়ে ছিল। ছয় সতীনে যুক্তি করে জীরেবর্তীর চুলের বনে সেই কাটা আঙ্গুলটা লুকিয়ে রাখল।

এদিকে আঙ্গুল কাটার জন্য ছেলেটা মরে পড়ে আছে। যে ছুরিতে আঙ্গুলটি কাটা হয়েছিল, সেই ছুরিতে ইতিপূর্বে বিষ লেগেছিল। যার জন্যে ছেলে মরে গেল। লোকজন, মন্ত্রী ইত্যাদি এসে হাজির, রাজাও এসেছে। রাজার বোন ছেলে আনতে গিয়ে দেখে ছেলে মরে গেছে। বিছানা লোয়ে লাখান হয়ে আছে। রাজার বোন ছেলের জন্য কাঁদতে লাগল। সুখের উৎসব শোকে পরিণত হলো। কে আঙ্গুল কেটেছে বার করতে হবে।

ছয় সতীনে, বললে, কাপড়-চোপড়, মাথার চুল ঝাড়াকোড়া নেওয়া হোক। তাই নেওয়া হলো। প্রথমে ঝিদের, তারপর অন্যান্য মেয়েদের, তারপর সব রাণীর। সবশেষে ছোটরাণী জীরেবতীকে ঝাড়া করতে গিয়ে তার চুলের মধ্যে ছেলের কাটা আঙ্গুল পাওয়া গেল। জীরেবতীকে সকলে যা-তা বলতে লাগল। কিন্তু রাজার পিয়ারের রাণী। ভাল করে কেউ কিছু বলতে পারল না।

রাজার বোন সাতদিন কিছু খেল না। বললে, আমার ছেলে যে মেরেছে তার রক্ত না দেখে আমি পানি খাবো না। রাজা ভাবল, জীরেবতী অকারণে আমার ভাগনেকে মেরে দিল। রাজা চাপে পড়ে আর বোনের কান্না দেখে  জীরেবতীকে মৃত্যুদণ্ড দিল।

জল্লাদ জীরেবতীকে বধ্যভূমিতে নিয়ে গেল। সেখানে মৃত্যুদন্ড পালন করা হলো। জীরেবতীকে মারতে পেরে ছয় সতীন খুব খুশী। কিন্তু রাজা তাদের মহলে আসে না। এদিকে যেদিন জীরেবতীকে মারা হলো, তার পর দিন দেখা গেল বধ্যভূমি আর নাই। সেখানে হয়েছে এক বিরাট দীঘি। তার জল ঢলঢল ঝিলমিল করছে। করছে। চারিপাড়ে সোনালী ঘাস ঝিলমিল গাছে ফুটেছে। দীঘির পাড়ে ঈশান কোণে একটা বড় কদম গাছ। কদমের ফুল। গাছ যেন হাসছে। গাছের ডালে পাশাপাশি বসে আছে একটা সুন্দর তোতা পাখী ও একটা সুন্দর ময়না পাখী। তোতা ময়নাকে কথা বলছে, আর ময়না হ্যাঁ দিচ্ছে।

তোতা: আমার মা, বাবা কুমোর কুমোরিনী ছিল লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: তাদের ছয়টা মেয়ে হয়েছিল লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: আবার মায়ের গর্ভ হলে। লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: বাপ বল্লে, মেয়ে যদি হয় তাহলে তুকে খুন করবো লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: আবার আমার মায়ের মেয়ে হলো লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: হাঁড়িতে রেখে জীরের ছুঁয়ে তাকে রেখে এলো লায় ময়ন।?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: ফকির তাকে কুড়িয়ে পেল লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: ফকির তার নাম রাখলে জীরেবতী লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ। 1

তোতা: আমি যুবতী হলাম লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: রাজা আমাকে দেখে অজ্ঞান হলো লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: রাজার সাথে আমার বিয়ে হলো লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: ফকির মরে গেল লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: আমার ছয় সতীন ছিল লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।-

তোতা: তারা আমার উপর খুব হিংসা করত লায় ময়না?

নয়না: হ্যাঁ।

তোতা: রাজার একটা বোন ছিল লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: তার কোলে একটা ছেলেছিল লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: সেই ছেলের মুখে ভাত লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: আমার ছয় সতীন ও আমি একঠায় হলাম লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: আমাকে জব্দ করার জন্যে বিষ মাখান ছুরি দিয়ে ছেলেটার আঙ্গুল ছয় সতীনে কাল লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: ছয় সতীনে কাটা আঙ্গুল আমার চুলে লুকিয়ে রাখল লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: ঝাড়াকুড়া দিতে গিয়ে আমার চুল হতে আঙ্গুল পাওয়া গেল লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: রাজা চাপে পড়ে আমাকে প্রাণদণ্ড দিল লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: আমার রক্তে দীঘি হলো লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: দেহ আমার কদম গাছ হলো লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: হাতগুলো ডালাপলা হলো লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: দাঁতগুলো আমার ফুল হলো লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: আমার ডান চোখ হলো তোতা লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: আমার বাম চোখ হলো ময়না লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

তোতা: রাজা যদি গাছ তলায় আসে, আবার আমি জীরেবর্তী হবো লায় ময়না?

ময়না: হ্যাঁ।

দীঘির পাশ দিয়ে পথ। সেই পথ দিয়ে লোকজন যাতায়াত করে আর ঐ তোতা ময়নার কথা শোনে। কথাটা একদিন রাজার কানে গেল। রাজা শুনল সেই বধ্য ভূমি নাই। সেথা হয়েছে এক দীঘি। ঢল ঢল করছে তার জল। পাড়ে পাড়ে সোনালী ঘাস। সতেজ কদম গাছ। গাছে ফুঁটে আছে ফল, গাছ যেন হাসছে। কদম গাছ, তোতা আর ময়না রাজা আর রাণীদের কথা বলছে।

এই কথা শুনে রাজা দীঘি দেখতে এলো। কদমের ডালে তোতা-ময়নার কথা শুনে রাজা সব জানতে পারল। রাজা কদম গাছের নিচে জীরেবতীর জন্য কাঁদতে লাগল। রাজার কান্না শুনে তোতা আর ময়মা উড়ে এসে রাজার হাতে বসল। সঙ্গে সঙ্গে দীঘি, গাছ, তোতা, ময়না সব মিলিয়ে গেল।

রাজা দেখল তার সামনে জীরেবতী দাড়িয়ে আছে। জীরেবতীকে দেখে আনন্দে রাজার চোখে জল এলো। সসম্মানে তাকে নিয়ে গেল তার মহলে। বোন সব শুনে দুঃখ করতে লাগল, আর ছয় রাণীকে রাজা মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বধ্য ভূমিতে পাঠাল। জহলাদ বধ্য ভূমিতে ছয় রাণীকে কাল। তাদের রক্তে একটা পচা পুকুর হলো। পচা পুকুরের চারিপাশে রাণী দেহগুলি হলো ছয় গুয়ে বাবলার গাছ। আর তাদের দুই চোখ হলো দুই দাঁড় কাক। কাঁটা গাছে তারা নিজেদের পাপের কথা বলতে লাগল।

[জীরেবর্তী গল্পটি বলতেন পুষ্যাশী (থানা ভরতপুর, জেলা মুর্শিদাবাদ) নিবাসিনী রসিদা খাতুন। তাঁর নিকট শুনেছিল চরখী (থানা কেতুগ্রাম, জেলা বর্ধমান) নিবাসিনী কুমারী মহবুবা খাতুন তাঁর নিকট হতে গল্পটি সংগৃহীত।]

Post a Comment