ঠাকুর ও তার ভৃত্য মধুসূদন

বাংলা রহস্য গল্প

এক গ্রামে এক পুরোহিত ঠাকুর বাস করতেন। তাঁর গ্রামের আশেপাশে অনেক গ্রামে বহু যজমান (পূজা গ্রহণকারী শিষ্য) ছিল। বিভিন্ন পূজা উপলক্ষে ঠাকুর এই সব গ্রামে যেতেন এবং যজমানের বাড়িতে পূজা করতেন। এই সব গ্রামের মধ্যস্থলে ঠাকুরপুকুর নামে একটি বড় গ্রাম ছিল। সেই গ্রামের ষষ্ঠীপূজা খুব বিখ্যাত ছিল। সাত-আটটি গ্রামের মানুষ এই গ্রামের ষষ্ঠীতলায় পূজা দিতে আসত। এই উপলক্ষে সেখানে একটি ছোটখাটো মেলাও বসত।

ঠাকুর মহাশয় একদিন আগেই সেখানে এসেছিলেন। পরদিন ছিল পূজা। মেয়েদের ভিড়। পূজা শেষ হতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আতপচাল, কলা, আম, মিষ্টি ইত্যাদিতে প্রচুর জিনিস জমা হলো। ঠাকুর একটি বড় বস্তায় সব বেঁধে রেখে তাঁর শিষ্যদের একটি জোয়ান মুনিষ (শক্তিশালী মজুর) দেখে দিতে বললেন। সেই গ্রামে মধুসূদন নামে এক আধপাগল জোয়ান ছিল। তার গায়ে খুব বল (শক্তি)। তাকেই সকলে ঠিক করে দিল; সে-ই ঠাকুর মশাইয়ের মালগুলো বাড়িতে দিয়ে আসবে।

ঠাকুর শুধালেন, "কী মজুরি লাগবে?"

মধুসূদন বলল, "মজুরি নেব না। তবে পথে যা দেখবে, তার মানে বলে দিতে হবে।"

ঠাকুর বললেন, "বেশ, তাই হবে।"

ঠাকুর ছাতা-ছড়ি নিয়ে চললেন আগু-আগু (সামনে-সামনে)। মধুসূদন মাথায় মোট নিয়ে চলল তার পিছু-পিছু।

ঠাকুরপুকুর গ্রাম ছাড়িয়ে তারা প্রায় দুই ক্রোশ রাস্তা এসেছেন। দুজনে কিছুটা ক্লান্ত হয়েছে।

ঠাকুর বললেন, "মধু, মোদকের দোকান থেকে এক পোয়া কদমা নিয়ে আয়। দুজনে জল খাব।"

মধুসূদন ঠাকুরের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে মোদকের দোকান হতে কদমা কিনে জল খেয়ে আবার হাঁটা শুরু করবে। মধুসূদন কদমা কিনতে গেল। ফেরার পথে মধুসূদন দেখল একদল লোক একটি যুবককে ঘিরে ধরে খুব তারিফ করে বলছে, "বাপকা বেটা, বাপকা বেটা।"

মধুসূদন ঠাকুরের হাতে কদমার ঠোঙা দিয়ে বলল, "ঠাকুর, ঐ যুবকটাকে সবাই 'বাপকা বেটা' বলছে কেন?"

ঠাকুর বললেন, "ও খুব বলবান মরদ (শক্তিশালী পুরুষ), বোধ হয় কোনো কঠিন কাজ করেছে, তাতেই লোকে এই কথা বলছে।"

মধুসূদন বলল, "না ঠাকুর, মানে বলতে হবে। নইলে থাকল তোমার মোট।"

ঠাকুর বললেন, "আচ্ছা, কদমা দিয়ে জল খা, যেতে যেতে সব বলবো।"

দুজনে জল খেয়ে পথ চলতে লাগল। আম, জাম, কাঁঠাল আর বট-পাকুড়ের ছায়া ঢাকা পথ। ঠাকুর বললেন, "শোন বেটা, কেনে ঐ যুবকটাকে 'বাপকা বেটা' বলছে।"

"এক গ্রামে ছিল এক রাজমিস্ত্রি। সে লোকের দালান-বাড়ি তৈরি করে দিত। এই রাজমিস্ত্রির ছিল একটি পুত্র। ছেলে লেখাপড়া ও হাতের কাজে বেশ ভালো ছিল। শৈশব-কৈশোর-যৌবনে যেমন সে লেখাপড়া শিখেছিল, তেমনি শিখেছিল ছুতার মিস্ত্রির কাজ। ছেলেটা লেখাপড়া শিখে চাকরি করতে চাইল। বাপ ছেলেকে বলল, 'তুই চলে গেলে আমি খুব কষ্ট পাবো। তুই বাড়িতেই থাক, বাপ।' ছেলেটি বলল, 'বেশ বাবা, তাই হবে।'

"ছেলেটা ভাবল, 'তাইতো, বাপ বুড়ো আর আমি জোয়ান। একটা কিছু না করলে কাঁহাতক বসে খাওয়া যায়!' গৃহস্থ বাড়িতে বহুদিনের পুরাতন একটি জামগাছ ছিল। লোকে বলত, এই জামগাছে নাকি বেহ্মদত্যি (ব্রহ্মদৈত্য) ছিল। তাদের গ্রামে এক লোকে জামগাছটি বিক্রি করল। তবে এখন আর সেই দত্যি ছিল না। ছেলেটি ঐ জামগাছটা কিনে তার কাঠ দিয়ে একটি ভালো খাট তৈরি করল। খাটটা ভারী সুন্দর হলো!

"আসলে, বেহ্মদত্যি চার পরীকে ধরে এনে জামগাছের মধ্যে বন্দী করে রেখেছিল। তারা গাছটা কেটে যখন খাট তৈরি করল, তখন পরী চারটে খাটের চারটে পায়ার মধ্যে আশ্রয় নিয়ে থাকল। রাতে তারা পালা করে খবর আনত এবং দত্যিকে দিত। ছেলেটা খাট তৈরি করে একরাত ঐ খাটের ওপর শুয়েছিল। সেই সময় সে ঐ চার পরীর কথাবার্তা শুনল। পরীরা তাকে বলল, 'ঐ খাট তুমি দেশের রাজাকে বিক্রি করে এসো, অনেক টাকা পাবে।'

"ছেলেটা রাজার নিকট খাট বিক্রি করতে গেল। রাজা খাটটা দেখল ও পছন্দ করলেন। রাজা শুধালেন এর দাম কত? ছেলেটি বলল, 'এর দাম আট হাজার টাকা।' রাজা বলল, 'দাম খুব বেশি।' ছেলেটি বলল, 'রাজা বাহাদুর, একরাত এই খাটে শয্যা গ্রহণ করুন, তারপর দাম দেবেন।' রাজা বললেন, 'বেশ, তাই হবে।'

"রাজা রাজপুরীতে নিজের ঘরে খাটটা পেতে রাখলেন। রাতে তার ওপর একা শুয়ে পড়লেন। রাজা শুয়ে আছেন আর দামের কথা ভাবছেন। এমন সময় বন্দী চার পরী খাটের পায়ার মধ্যে কথাবার্তা বলতে লাগল।

"পরীরা বলল, 'রাজাতো ঘুমিয়ে পড়ল, রাজ্যে কী হচ্ছে দেখতে হবে।' এই বলে প্রথম পায়াটা বলল, 'তোরা রাজাকে ভালোভাবে ধরে রাখিস, আমি প্রথম প্রহরটা দেখে আসি।' কিছুক্ষণ পর প্রথম পায়া ফিরে খাটে লেগে গেল। অন্য তিনজন শুধাল, 'কী দেখলি?' প্রথম পায়া বলল, 'এক দুষ্ট পরী রাজাকে মারতে আসছিল। রাজপুরীর দ্বারেই তাকে ধরলাম। তাকে মেরে সিংহদ্বারের ওপর রেখে এসেছি। তা'নাহলে আজ রাজা মারা যেত।'

"এরপর দ্বিতীয় পায়া বলল, 'তোরা তিনজনে খাটটা ধর, আমি একবার দেখে আসি।' এই বলে দ্বিতীয় পায়াটা উড়ে গেল। কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় পায়াটা ফিরে এলো। অন্য তিনজন শুধাল, 'তুই কী দেখে এলি?' দ্বিতীয় পায়াটা বলল, 'এক আজদাহা সাপ রাজাকে খেতে আসছিল। আমরা না থাকলে আজ রাজাকে ঠিক খেয়ে নিত। আমি তাকে সাত টুকরো করে কেটে রাজপথের ওপর রেখে এসেছি।'

"এরপর তৃতীয় পায়া বলল, 'আমি একটু যাই।' এই বলে সে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর সে ফিরে এলো। অন্য তিনজন শুধাল, 'কী দেখে এলি?' তৃতীয় পায়া বলল, 'এই রাজার কর্মচারীরা খুব খারাপ ও অসাধু। যে লোকটা নদীর ধারে পাহারা দিচ্ছিল, সে খুব দুষ্ট। একজন প্রজা তার স্ত্রী ও দুটো ছেলে নিয়ে নদী পার হচ্ছিল। পাহারাদারটা তাদের মেরে নদীর বালিতে পুঁতে দিল আর তাদের গহনা-গাঁটি, টাকা-কড়ি সব নিয়ে বাড়িতে রেখে এসে আবার পাহারা দিতে গেল।'

"এরপর চতুর্থ পায়া বলল, 'ভাই, তোরা সব খাটটা ভালো করে ধর, রাজা যেন পড়ে না যায়। আমি একবার দেখে আসি।' এই বলে চতুর্থ পায়াটা চলে গেল। কিছুক্ষণ পর চতুর্থ পায়াটা ঘুরে এলো। অন্যেরা শুধাল, 'তুই কী দেখলি?' চতুর্থ পায়া বলল, 'আমি যা দেখলাম, তা বলা যাবে না। এই রাজার বিবি খুব খারাপ। সে রাজার ঘেঁষেড়ার (ঘোড়ার দেখভালকারী) সঙ্গে আছে। রোজ রাতে একবার সে ঘেঁষেড়ার ঘরে যায়। আমি যখন যাচ্ছিলাম, তখন সে ঘেঁষেড়ার ঘরে ঢুকল। আমি ঘেঁষেড়ার সঙ্গে একই ঘরে তাকে শিকল দিয়ে রেখে এসেছি।'

"রাজা ঘুমায়নি। সে সব শুনল ও খাট বিক্রেতাকে তারিফ করল। পরদিন উঠে রাজা দেখেন, সিংহদ্বারে একটি পরী মরে পড়ে আছে। রাজপথের ওপর মরে পড়ে আছে এক আজদাহা সাপ। তারপর রাজা গেলেন নদীর ধারে সেই পাহারাদারকে নিয়ে, যে রাতে নদীর ধারে পাহারা দিচ্ছিল। তাকে সামনে রেখে অন্য লোক দিয়ে নদীর বালু খুঁড়ে তিনজনের লাশ পাওয়া গেল। তার বাড়িতে পাওয়া গেল টাকা-কড়ি, গহনা। রাজা পাহারাদারের প্রাণদণ্ড দিলেন। এরপর রাজা জল্লাদকে নিয়ে গেলেন ঘেঁষেড়ার ঘরে। ঘেঁষেড়া ও রাণী তখন ভয়ে কাঁদছে। রাজা তাদের ডালকুত্তা (খোঁজ দেওয়া কুকুর) লাগিয়ে খাওয়ালেন। তারপর রাজা খাটওয়ালাকে ডেকে যে দাম চেয়েছিল, তার দ্বিগুণ দাম দিলেন। ছেলেটি সেই টাকা নিয়ে বাপের হাতে দিল।"

ঠাকুর গল্প শেষ করে মধুসূদনকে বললেন, "এইজন্য ঐ ছেলেটিকে ঘিরে লোকে বলছে, 'বাপকা বেটা'।"

ঠাকুর ও মধুসূদন পথ চলতে লাগল।

কিছুদূর যাবার পর ঠাকুর মধুসূদনকে মোট নামাতে বললেন। মোট নামিয়ে দুজনে বিশ্রাম করতে লাগল।

ঠাকুর বললেন, "মধুসূদন, এই ভাঁড়টা নিয়ে গ্রামের ভেতর থেকে একটু জল নিয়ে আয়। খুব জল পিপাসা লেগেছে।"

মধুসূদন গ্রামের মধ্যে গিয়ে একটি ইন্দারা (কুয়ো) হতে এক ভাঁড় জল নিয়ে আসছে। পথের পাশে সেই দেশের রাজার বাড়ি। সাত মহল্লা বিরাট বাড়ি। রাস্তার ধারে ফুলের বাগান ঘেরা। রাজবাড়ির একটি ঘরে একটি সুন্দর যুবক ও একটি সুন্দরী যুবতী বলাবলি করছে, "গাল মে চুমা গলমে হার", আর মেয়েটি বলছে, "কান মে মোড়া পোঁদ মে ঘোড়া।"

মধুসূদন জল দিয়ে ঠাকুরের কাছে ফিরে এলো। ঠাকুর জল খেয়ে ঠান্ডা হয়ে বললেন, "হাঁটা দে বেটা।"

মধুসূদন বলল, "ঠাকুর মশাই, রাজবাড়ির মধ্যে একটি যুবক যুবতীকে বলছে, 'গাল মে চুমা গলমে হার', আর যুবতী যুবককে বলছে, 'কান মে মোড়া পোঁদ মে ঘোড়া'। একথার ভেদ কী?"

ঠাকুর বললেন, "দূর বেটা, ওরা স্বামী-স্ত্রী, নিজেদের মধ্যে মশকরা (ঠাট্টা) করছে।"

মধুসূদন বলল, "তা হবে না ঠাকুর, থাকলো তোমার মোট। আমি চললাম বাড়ি।"

ঠাকুর বললেন, "তবে শোন, গল্প বলতে বলতে হাঁটা দেওয়া যাক।"

"এই দেশে এক রাজা আছেন। রাজার একমাত্র ছেলে। ছেলেটি লেখাপড়া, অস্ত্র শিক্ষা সব কিছুতেই পারদর্শী। ছেলেটি ক্রমে যুবক হয়ে উঠল। সুন্দর সুঠাম চেহারা। ছেলেটির বন্ধুদের একে একে বিয়ে হলো, কিন্তু রাজপুত্রের বিয়ে হয় না। রাজপুত্রের বন্ধুরা বলল, 'এবার বিয়ে কর, আমরা বরযাত্রী যাব, ভালো খাওয়া হবে।' এই সব শুনে ছেলে একদিন গোঁসা ঘরে খিল দিল।

"ছেলের বাবা-মা গোঁসা ঘরের দরজায় গিয়ে শুধালেন, 'কেন গোঁসা?' ছেলে বলল, 'আমার বন্ধুদের সবার বিয়ে হয়ে গেল, আর আমার কেন বিয়ে হচ্ছে না?' রাজা-রাণী বললেন, 'তোমার বিয়ে শৈশবে হয়ে গেছে অন্য দেশের এক কন্যার সঙ্গে।' এই কথা শুনে রাজপুত্র গোঁসা ঘর হতে বেরিয়ে এলো। বন্ধুদের বলল, তার বিয়ে হয়েছে, তবে অনেক শৈশবে। তার সে কথা মনে নাই।

"বন্ধুরা বলল, 'একবার ছদ্মবেশে বৌকে দেখে এসো, কেমন বৌ!'

"রাজপুত্র সুনারের (স্বর্ণকারের) ছদ্মবেশে রাজকন্যার দেশে গেল, যেখানে তার বিয়ে হয়েছিল। সঙ্গে নিল ভালো ভালো সোনা ও হীরের হার। রাজা তার সঙ্গে অনেক লোক দিলেন। রাজপুত্র লোকজন সঙ্গে নিয়ে সেই দেশে এলো। ছদ্মবেশ ধারণ করে রাজ্যে প্রবেশ করল ও তার লোকদের বিদায় দিল। ছদ্মবেশী সুনার রাজার নিকট গিয়ে বলল, 'মহারাজ, আমি কিছু দামি টাকার হার এনেছি, আপনার বাগানবাড়িতে গিয়ে সেখানে বিক্রয় করতে চাই।' রাজা বললেন, 'বেশ, তাই হোক।'

"রাজ্যের মেয়েরা খবর পেয়ে হার কিনতে আসে, কিন্তু রাজকন্যা কোনোদিন আসে না। একদিন রাজকন্যার এক সহচরী হার দেখতে এলো বাগানে। রাজপুত্র তাকে বলল, সে যদি রাজকন্যাকে একবার এখানে আনতে পারে, তাহলে একটা ভালো হার তাকে পুরস্কার দেবে। সহচরী একদিন রাজকন্যাকে বলল, 'কন্যা, বাগানবাড়িতে একটা ভালো হার এনেছে, চলো দেখে আসি।' রাজকন্যা বলল, 'ও-রকম হার আমার অনেক আছে।' সহচরী রোজ বলে, 'চলো বাগানে হার দেখে আসি।' অবশেষে রাজকন্যা একদিন সহচরীকে নিয়ে তাদের বাগানে এলো। দেখল এক সুন্দর যুবক হার নিয়ে বসে আছে। ছদ্মবেশী রাজপুত্র তার স্ত্রীকে দেখে খুব মুগ্ধ হলো। তারপর সহচরীকে চোখ ইশারা করল। সহচরী একটু দূরে সরে গেল। রাজপুত্র সেই অবসরে একটি ভালো গজমতির হার রাজকন্যার গলায় পরিয়ে দুই গালে চুমা খেল। এ সব কেউ দেখল না। রাজকন্যা নিজে অপমানিত বোধ করল, কিন্তু কাউকে কিছু বলল না। সহচরীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। রাজপুত্র তারপর দেশে ফিরে গেল ও বন্ধুদের নিকট নিজ স্ত্রীর প্রশংসা করতে লাগল।

"পরপুরুষ গলায় হার দিয়ে গালে চুমা খেয়েছে, তাই রাজকন্যা মন-মরা হয়ে থাকে। এমনি করে কন্যা অসুখে পড়ল। একদিন এক সাধু এসে রাজাকে বলল, 'আমি আপনার কন্যার অসুখ ভালো করে দেব।' রাজকন্যার সঙ্গে সাধুর দেখা হলো। সাধু বলল, 'কন্যা, এক সুনার তোমাদের বাগানে হার বেচতে এসেছিল?' রাজকন্যা বলল, 'হ্যাঁ।' সাধু শুধাল, 'সে তোমার গলায় একটা হার পরিয়ে দিয়ে দুই গালে চুমা খেয়েছে?' কন্যা বলল, 'হ্যাঁ।' সাধু বলল, 'সেই সুনার তোমার স্বামী। সে রাজার ছেলে, ছদ্মবেশে তোমাকে দেখতে এখানে এসেছিল। তার সঙ্গে শৈশবে তোমার বিয়ে হয়েছে। তুমি কি হার আর চুমার প্রতিশোধ নিতে চাও?' রাজকন্যা বলল, 'প্রতিশোধ নিতে চাই।'

"সন্ন্যাসী বলল, 'তুমি এক কাজ করো, ভালো ভালো দশটা আরবী ঘোড়া কিনে পুরুষের ছদ্মবেশে ঐ রাজার দেশে যাও। সেই রাজার বাগানে তুমি ঘোড়া বিক্রেতার ছদ্মবেশে থাকবে। ঘোড়া বেচবে, তবে দুটি ভালো ঘোড়া বেচবে না—একটি রাখবে নিজের জন্য, অন্যটি তোমার স্বামীর জন্য। সে খুব ঘোড়া পছন্দ করে। তাকে একটা ভালো ঘোড়া দিয়ে সময় বুঝে কান দুটি মলে দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে আসবে।'

"এই সব শুনে দশটা ভালো আরবী ঘোড়া নিয়ে রাজপুত্রের ছদ্মবেশে রাজকন্যা স্বামীর দেশে গেল। ঘোড়ায় চড়ে সে অভ্যাস করে রেখেছিল। একটি ভালো ঘোড়ায় চড়ে রাজার নিকট গিয়ে তার বাগান বাড়ি চাইল ঘোড়া বেচার জন্য। রাজাকে একটা ভালো ঘোড়া দিল। বাগান থেকে রোজ ঘোড়া বিক্রি করে। শেষে দুইটি রইল। রাজপুত্র তার সঙ্গীদের নিয়ে ঘোড়া বিক্রির জন্য ঘোড়াটি নিল। ঘোড়া বিক্রেতা বলল, 'আগে ঘোড়ায় চেপে ঘোড়া পছন্দ করুন, তারপর দাম হবে, যদি ঘোড়া পছন্দ হয়।' রাজার ছেলে একটা ঘোড়ায় চাপল, আর বিক্রেতা একটা ঘোড়ায় চাপল। দুজনে চেপে সদর পথের ধারে এলো। ঘোড়া বিক্রেতা সদর পথে ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে চট্জলদি রাজপুত্রের দুই কান মলে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া ছুটিয়ে নিজ দেশে ফিরে এলো। রাজপুত্র হতভম্ব হয়ে গেল। তবে এ ঘটনা ঘোড়া বিক্রেতা ও রাজপুত্র ছাড়া কেউ জানল না।

"তারপর দুই রাজা মহাসমারোহে বরযাত্র সহ ধুমধাম করলেন। রাজপুত্র নিজ স্ত্রীকে বাড়িতে নিয়ে এলো। এখন তারা হাস্য পরিহাসের ছলে প্রথমে রাজপুত্র রাজকন্যাকে বলছে, 'গাল মে চুমা গল মে হার'। এই কথা শুনে রাজকন্যা বলছে, 'একথা তুমি কী করে জানলে বলো!' তারপর রাজকন্যা বলছে, 'কান মে মোড়া পোঁদ মে ঘোড়া'। এই কথা শুনে রাজপুত্র বলছে, 'তুমি একথা কিভাবে জানলে বলো!' এই বলে দুজনে খুব হাসছে।"

ঠাকুর মধুসূদনকে বললেন, "শুনলি বেটা? চ, তাড়াতাড়ি চ।"

দুজনে চলতে লাগল।

কিছুদূর যাওয়ার পর আর এক রাজার রাজ্য। রাজপুরীর পাশ দিয়ে পথ। তারা দুজনে যখন রাজপুরীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, তখন দেখল রাজার একটি বারো-তেরো বৎসর বয়স্ক পুত্রকে ঘিরে রাজ্যের বহু লোক বলছে, "ধন্য তুমি রাজপুত্র, বাপের আঁটকুড়ো নাম ঘুচালে।"

মধুসূদন একথা শুনে ঠাকুরকে বলল, "ঠাকুর, ঐ ছেলেটাকে ঘিরে লোকে এ কথা বলছে কেন?"

ঠাকুর বললেন, "ও কিছু নয়।"

মধুসূদন বলল, "না, এ কথার ভেদ বলতে হবে, নইলে থাকলো তোমার মোট, আমি চললাম বাড়ি।"

ঠাকুর বললেন, "নারে না, যাস না। আমি তো বাড়ি চলে এসেছি, চ বাবা। যেতে যেতে গল্পটা বলছি।"

কথা বলতে বলতে তারা পুরী পার হয়ে এলো। ঠাকুর মধুসূদনকে বললেন, "যা বেটা, মণ্ডা কিনে আন জল খাই।"

জল খেয়ে দুজনে পথ চলতে লাগল। রাস্তার দু'ধারে আম, জাম, কাঁঠাল, বট, পাকুড় আর নিমের গাছ। ঝির ঝির করে বাতাস বইছে। ঠাকুর মধুসূদনকে গল্প বলতে লাগলেন।

এই যে রাজবাড়ি। এই রাজার কোনো সন্তান ছিল না। রাজা ছিলেন আঁটকুড়ো (নিঃসন্তান)। সকাল হলে আঁটকুড়ো রাজার নাম কেউ করতো না বা মুখ দেখতো না। যদি কেউ দেখতো, তার দিন ভালো যেত না। রাজার সন্তানাদি নাই, রাজা আছেন মনোদুঃখে। রাজা একদিন তার রাজ্যের বড় বড় গণৎকার ডেকে পাঠালেন। গণৎকার রাজদরবারে এলো। রাজা তাদের বলল, 'গণনা করে দেখুন, আমার কয়টি সন্তান আছে এবং কখন হবে।'

গণৎকারগণ রাজা-রাণীর জন্ম দিন, বার, তিথি, নক্ষত্র ইত্যাদি বিচার করল। খড়ি পাতল (গণনার সরঞ্জাম দিয়ে হিসেব করল)। সকল গণৎকারই গণনা করে আর মাথা নাড়ে। অবশেষে বলল, 'মহারাজ, আপনার কোনো সন্তানাদি হবে না। আপনি এবং আপনার স্ত্রী বাঁঝা (বন্ধ্য)।' এই কথা শুনে রাজা খুব রেগে গেলেন। শহর কোতোয়ালকে হুকুম দিলেন, 'সব বেটা গণৎকারকে কারাগারে বন্দী কর।'

গণৎকারগণ কারাগারে চলে গেল। তারা যখন কারাগারে যাচ্ছে, তখন দেখল কাদা মাখা গায়ে নেংটি (একটুকরা কাপড়) পরে এক সন্ন্যাসী রাজবাড়ির সিংহদ্বারের পাশে বসে আছে। সে গণৎকারদের শুধাল, 'তোমাদের কী হয়েছে?' তারা সব কথা বলল। এই কথা শুনে সন্ন্যাসী বলল, 'আমি একবার গুণে দেখতাম।' কিন্তু কেউ তার কথায় কান দিল না। তারা বলল, 'বড় বড় সন্ন্যাসী কিছু পারল না, বেটা কাদামাখা নেংটি-পরা সন্ন্যাসী কী করবে?'

ইতিমধ্যে রাজা স্বয়ং সেখানে এসে হাজির। সন্ন্যাসী রাজার পাদুটো চেপে ধরল। রাজা বলল, 'কী চাই?' সন্ন্যাসী বলল, 'আপনার সন্তান হবে কি হবে না, আমি একবার দেখতে চাই।' রাজা বলল, 'ঠিক আছে, আসুন।'

সন্ন্যাসী রাজার সঙ্গে রাজদরবারে এলো। সন্ন্যাসী বলল, 'মহারাজ, আপনার সন্তান নাই। আমি আপনাকে বর দিচ্ছি। এই বরে আপনার স্ত্রীর গর্ভে জমজ সন্তান হবে। বড়টি আমাকে দিতে হবে আর ছোটটি আপনার থাকবে। আমার সঙ্গে আপনাকে এই সত্য বন্দী (প্রতিশ্রুতিবদ্ধ) করতে হবে।' রাজা বললেন, 'ঠিক আছে, আমি সত্য-বন্দী করলাম।' সন্ন্যাসী বলল, 'সন্তানের বয়স যখন বারো বৎসর হবে, তার মধ্যে আমি নিয়ে যাব।' এই বলে সন্ন্যাসী চলে গেল।

এক বৎসর পর রাজার স্ত্রী জমজ পুত্র সন্তান প্রসব করল। রাজা মনের আনন্দে গণৎকারদের মুক্তি দিলেন। বড় ছেলেটি হলো বেশ চালাক-চতুর, আর ছোট ছেলেটি হলো আধ-খেপা (কিছুটা পাগল)। বারো বৎসর ঠিক পূর্ণ হবার আগে সন্ন্যাসী এলো। রাজা আধ-খেপাটাকে দিতে চাইলেন। সন্ন্যাসী বলল, 'মহারাজ, সত্যবন্দী খেলাপ (ভঙ্গ) করবেন না, তা'হলে আপনার অমঙ্গল হবে।' রাজা কি আর করে, বড় ছেলেটিকে সন্ন্যাসীর হাতে দিলেন।

সন্ন্যাসী ছেলেটিকে নিয়ে যায়। কিছুদূর গিয়ে দেখল, সামনে দুইদিকে দুটো পথ। একটা বারো দিনের, অন্যটা বারো বৎসরের। সন্ন্যাসী রাজপুত্রকে শুধাল, 'কোন্ পথে যাবে?' রাজপুত্র বলল, 'চলুন বারো বৎসরের পথে। আস্তানা নাই, পথে পথে ঘোরা হবে, দেশাদি দেখা হবে।' এই কথা যেই বলল, অমনি শাঁ করে সন্ন্যাসী আর রাজপুত্র সেখান হতে উড়ে আকাশ পথে চলে গেল।

সন্ন্যাসী তার সাধনবলে রাজপুত্রকে নিয়ে এলো এক গভীর অরণ্যে। এই অরণ্যের মধ্যস্থলে একটি সরোবর। সরোবরের দক্ষিণ পাড়ে সন্ন্যাসীর আশ্রম। পশ্চিম পাড়ে এক ফুলের বাগান, তবে সেখানে জবা ফুলের গাছ বেশি। উত্তর দিকের পাড়ে একটি কালী ঠাকুরের মন্দির। সন্ন্যাসী রাজপুত্রকে বলল, 'বাবা, সব দিক যাবে, কিন্তু ঐ পূর্বদিকে যাবে না।'

সন্ন্যাসী ও রাজপুত্র থাকে একসঙ্গে। সন্ন্যাসী সকাল হলেই রাজপুত্রকে চাল-ডাল সব দিয়ে যায়। রাজপুত্র রান্না করে রাখে, সন্ন্যাসী এসে খায়। রাজপুত্র একটি জিনিস লক্ষ্য করল, সন্ন্যাসী যেদিন বলে, 'কাছে কাছে থাকবো', সেদিন আসে অনেক রাতে। আর যেদিন বলে, 'অনেক দূরে যাব', সেদিন ফিরে আসে দুপুর বেলায়।

রাজপুত্র কৌতূহলী হয়ে একে একে দেখল ফুলের বাগান ও দেবীর মন্দির। কিন্তু পূর্বদিকে কী আছে? সন্ন্যাসী যেতে বারণই বা করল কেন? মনে কৌতূহল জেগে উঠল। অনেকদিন পর সন্ন্যাসী বলল, 'আজ বাবা তাড়াতাড়ি রান্না কর দেখি, আমি আজ কাছাকাছি থাকবো।' সন্ন্যাসী চলে গেল।

রাজপুত্র ধীরে ধীরে পূর্বদিকের পাড়ে গিয়ে হাজির হলো। দেখল একটি বড় বেলগাছ শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছে। গাছের ডালে ডালে ঝুলছে অনেকগুলি মড়ার কঙ্কাল। রাজপুত্র গুণে দেখল নিরানব্বইটি কঙ্কাল ডালে ডালে ঝুলছে। গাছের তলায় পড়ে আছে মড়ার মাথা। ছেলেটা চিন্তা করছে, গাছে নিরানব্বইটি কঙ্কালই বা কেন ঝুলছে, আর গাছের নিচে মড়ার মাথাই বা কেন পড়ে আছে!

ঠিক এমন সময় শাঁ করে একটা মড়ার কঙ্কাল নিচে নামল। বলল, 'রাজপুত্র, ভয় খেয়ো না। আমার নাম গোপাল। এই যে সন্ন্যাসীকে দেখছ, এ খুব দুষ্ট। বৈতালিক সিদ্ধির জন্য কালীদেবীর মন্দিরে নিরানব্বইটি নরবলি দিয়েছে। আগামী শ্রাবণ মাসের মধ্যে যে অমাবস্যা তিথি আসছে, সেই তিথিতে ঐ কালী মন্দিরে সন্ন্যাসী তোমাকে বলি দিয়ে বৈতালিক সিদ্ধি লাভ করবে। তোমাকে এই সরোবরে স্নান করাবে, পরাবে লালপাড় কাপড়; কপালে দিবে সিঁদুরের ফোঁটা, গলায় পরাবে জবা ফুলের মালা। হাতে ও পায়ে লাল আলতা পরাবে।'

এই কথা শুনে রাজপুত্র ভয় পেয়ে গিয়ে গোপাল কঙ্কালের পা দুটো চেপে ধরে বলল, 'গোপাল, আমাকে বাঁচার উপায় করে দাও।' গোপাল বলল, 'আমাকে ঐ সন্ন্যাসী প্রলোভন দিয়ে ভুলিয়ে এনে বলি দিয়েছে। আমি ওর সর্বনাশ করতে চাই। তুমি স্নান ও সিঁদুর, মালা, কাপড় সব পরবে। সন্ন্যাসী তারপর তোমাকে এই বেলতলায় পাঠাবে, তুমি এসে তিনবার গোপাল বলে ডাকবে। তারপর আমাকে কাঁধে করে নিয়ে যাবে। যাও, এখন আশ্রমে যাও।'

রাজপুত্র সব শুনে আশ্রমে চলে এলো। রাতে সন্ন্যাসী ফিরে এলো। এইভাবে দিন যায়। তারপর এলো সেই শ্রাবণ অমাবস্যা।

সন্ন্যাসী সেদিন আর কোথাও গেল না। জবা ফুল তুলে মালা গাঁথল। দেবী পূজার আয়োজন করতে লাগল। সন্ধ্যা হলে রাজপুত্রকে সরোবরে স্নান করাতে নিয়ে গেল। রাজপুত্র বলল, 'রাতে স্নান করলে শরীর খারাপ করবে।' সন্ন্যাসী বলল, 'আজ মায়ের মন্দিরে পূজা দিতে যাব, স্নান করতে হয়।' রাজপুত্র তো সব জানে, সে স্নান করল। তারপর লালপাড় কাপড় পরাল। গলায় জবাফুলের মালা দিল। কপালে দিল সিঁদুরের ফোঁটা। হাতে ও পায়ে লাল আলতা পরাল। তারপর সন্ন্যাসী তাকে মন্দিরে নিয়ে গেল।

কিছুক্ষণ পর সন্ন্যাসী বলল, 'যাও আজ পূর্বপাড়ে। সেখানে দেখবে বেল গাছে অনেক মড়া ঝুলছে, একটাকে কাঁধে করে নিয়ে এসো।' রাজপুত্র পূর্বদিকে চলে গেল। তারপর বেলতলাতে গিয়ে 'গোপাল' 'গোপাল' বলে ডাকল তিনবার। গোপাল নেমে এলো। রাজপুত্র তাকে কাঁধে নিল।

গোপাল বলল, 'আমাকে দেবীর সামনে লম্বালম্বি রাখা হবে। এরপর সন্ন্যাসী তোমাকে বলবে, দেবীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করো। তুমি বলবে, আমি রাজপুত্র, কোনোদিন প্রণাম করি নাই। কেমন করে প্রণাম করতে হবে, একবার দেখিয়ে দিন।' সন্ন্যাসী যেমনি দেবীকে প্রণাম করে দেখাতে যাবে, সেখানে থাকবে একটি খাঁড়া (বড় তরবারি); তাই দিয়ে সন্ন্যাসীকে এক কোপে কেটে ফেলবে। তারপর বলবে, 'বৈতালিক, এখন তুমি আমার।'"

"রাজপুত্র বলল, 'বেশ, তাই হবে।'

রাজপুত্র গোপালকে মন্দিরে নিয়ে এলো। কঙ্কালটা লম্বালম্বি রাখা হলো দেবীর সামনে। সন্ন্যাসী বলল, 'রাজপুত্র, দেবীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করো।' রাজপুত্র বলল, 'প্রণাম কী, জানি না। আমি রাজপুত্র, কোনোদিন এভাবে প্রণাম করি নি। তুমি একবার দেখিয়ে দাও।' সন্ন্যাসী বলল, 'এইভাবে।' সন্ন্যাসী যেমন দেবীকে প্রণাম করতে গিয়েছে, অমনি রাজপুত্র এক কোপে খাঁড়া দিয়ে তার মস্তক দেহচ্যুত করল, আর বলল, 'বৈতালিক, তুমি আজ হতে আমার।' এই কথা তিনবার বলল। গোপাল আর সন্ন্যাসী হলো রাজপুত্রের বৈতালিক (ভূত বা প্রেত, যারা ইচ্ছাপূরণ করে)।

তার বৈতালিকদের আদেশ দিল, 'চল, আমায় আমার বাড়ি নিয়ে চল।' সঙ্গে সঙ্গে রাজপুত্রকে তারা তার পিতার রাজ্যে এনে দিল। এসে শুনল, তার ছোট ভাইটি মারা গেছে।"

ঠাকুর মধুসূদনকে বললেন, "এই ছেলে ফিরে এসে রাজাকে সব কথা বলল; তাই প্রজারা বলছে, 'বাপের আঁটকুড়ো নাম তুমি ঘুচিয়েছ'।"

[বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানার চরখী গ্রাম নিবাসী মহবুবা খানের নিকট হতে সংগৃহীত।]

Post a Comment