উজানী নামে এক সমৃদ্ধ নগর ছিল, যার রাজা ছিলেন দণ্ডধর। তাঁর পুত্র মদনকুমার রূপে-গুণে ছিলেন অদ্বিতীয়। যৌবনে একবার তিনি শিকারে গিয়ে পরীদের অলৌকিক প্রভাবে ভাটী নগরের মধুমালা-র ঘরে নীত হন।
অজয় নদীর তীরে অবস্থিত ছিল উজানী রাজ্য। তার রাজধানীও ছিল উজানী নগর। এই রাজ্যের রাজার নাম ছিল দণ্ডধর। লোকলস্করে, হাতিশালে হাতিতে, ঘোড়াশালে ঘোড়ায় পুরী রমরম করত, তবুও রাজা-রানির মনে সুখ ছিল না, কারণ তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না।
কিছুদিন পর শোনা গেল রানি গর্ভবতী। রাজ্যে আনন্দের ঢেউ বইল। দশমাস দশ দিন পর রানি এক সুন্দর পুত্র প্রসব করলেন। তার রূপে যেন ঘর আলো হয়ে উঠল। ছেলেটি শশীকলার মতো ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। তার নাম রাখা হলো মদনকুমার।
ক্রমে মদনকুমার যৌবনে পদার্পণ করলেন। রাজপুত্র লেখাপড়া, অস্ত্রবিদ্যা, ঘোড়ায় চড়া—সব কিছুতে পারদর্শী হয়ে উঠলেন। যেমন ছিল তাঁর রূপ, তেমনি ছিল তাঁর গুণ।
একদিন রাজপুত্র তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের বললেন, "চলো শিকারে যাই।" লোকলস্কর নিয়ে মদনকুমার নিকটবর্তী এক বড় বনে শিকারে গেলেন। সারাদিন বন তোলপাড় করেও কোনো শিকার পাওয়া গেল না। বনের মধ্যস্থলে ছিল এক সু-বৃহৎ সরোবর। সেই সরোবরের ধারে অনেক তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করা হলো। একটি ভালো তাঁবুর মধ্যে সোনার খাটের উপর শুয়ে ক্লান্ত মদনকুমার ঘুমিয়ে পড়লেন।
এই সরোবরে গভীর রাতে পরীরা স্নান করতে আসত। সেদিন চার বোন—কালোপরী, ঝালোপরী, ধলোপরী ও নিদ্রাপরী—সরোবরে স্নান করতে এসে দেখল, কারা যেন তাঁবু ফেলেছে। নিদ্রাপরী সকলকে ঘুম পাড়িয়ে দিল।
চার বোন দেখল, সোনার খাটে শুয়ে আছেন মদনকুমার। তাঁর রূপে যেন বন আলো হয়ে আছে। তাঁর রূপ দেখে চার বোনের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেল: কে বেশি সুন্দর—উজানী রাজপুত্র মদনকুমার, না ভাটী নগরের রাজা বাসীকরের মেয়ে মধুমালা?
তখন পরীরা ঠিক করল, মদনকুমারকে ভাটী নগরে নিয়ে গিয়ে মধুমালার পাশে রেখে দেখতে হবে কে বেশি সুন্দর। চার পরী খাটের চার কোণ ধরে মদনকুমারকে নিমিষে উড়িয়ে নিয়ে গেল ভাটী নগরে। সেখানে মধুমালার খাটের পাশে রাখল মদনকুমারের খাট।
দুষ্টুমি করে ঝালোপরী দু'জনকে জাগিয়ে দিল। দু'জনার সঙ্গে দু'জনার পরিচয় হলো। এরপর তাঁরা আঙটি বিনিময় করে বিবাহ করলেন এবং কিছু কথাবার্তা বললেন। রাত প্রায় শেষ হবে, তাই নিদ্রাপরী আবার তাঁদের ঘুম পাড়িয়ে দিল। দু’জনে ঘুমিয়ে পড়লেন।
পরীরা তখন মধুমালার খাটে মদনকুমারকে আর মদনকুমারের খাটে মধুমালাকে রেখে মদনকুমারকে উড়িয়ে এনে আবার বনের মধ্যে তাঁর তাঁবুতে রেখে দিল।
সকাল হলে মদনকুমার জেগে উঠলেন। কিন্তু কোথায় মধুমালা? রাজপুত্র "মধুমালা! মধুমালা!" বলে বিলাপ করতে লাগলেন। তাঁর বন্ধু-বান্ধব বলল, "এসব স্বপ্ন।" রাজপুত্র বললেন, "যদি স্বপ্ন হয়, তাহলে আঙটি ও খাট কেন বদল হলো?"
শিকার ফেলে সকলে উজানীতে ফিরে এলেন। রাজা দণ্ডধর অনেক চেষ্টা করলেন। বহু অনুসন্ধান করেও মধুমালার সন্ধান পাওয়া গেল না।
উজানী নগরে রাজার নিকট থাকত এক ব্রাহ্মণ, যার বাড়ি ছিল সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে। সে রাজাকে বলল, "আমি মধুমালার দেশ চিনি। সেখানে যেতে হলে বহু ধনরত্নের দরকার।"
সাতটি বড় বড় নৌকায় অনেক ধনরত্ন, টাকাকড়ি, খাবারদাবার নেওয়া হলো। অন্য একটি ময়ূরপঙ্খী নৌকায় উঠলেন মদনকুমার ও সেই ব্রাহ্মণ।
শুভ দিনে নৌকা ছেড়ে দেওয়া হলো। নৌকা চলতে লাগল। এইভাবে সাত দিন সাত রাত নৌকা চলল। ব্রাহ্মণ ছিল কুচক্রী। সে কৌশলে নিজের দেশে ফেরার সুযোগ খুঁজছিল।
অনেক রাতে ব্রাহ্মণ কৌশল করে নিজের গাঁয়ের ঘাটে নৌকা ভেড়াল। তারপর মদনকুমারের নৌকার মাঝিমাল্লাদের নামিয়ে মদনকুমারের নৌকার নোঙর কেটে দিল। ঘুমন্ত মদনকুমার স্রোতের অনুকূলে ভেসে চললেন। ব্রাহ্মণ ধনরত্ন নিয়ে বাড়ি চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর মদনকুমার জেগে উঠে সব জানতে পারলেন। তিনি নিজের ভাগ্যের জন্য বিলাপ করতে লাগলেন। সকাল হলে নৌকা জলের বিরাট ঢেউ সহ্য করতে পারল না। হাল, দাঁড় কিছুই না থাকায় নৌকা ডুবে গেল। মদনকুমার জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটতে লাগলেন। তারপর ক্লান্ত হয়ে ভাসতে ভাসতে এক নদীর ঘাটের সন্নিকটে চড়ার উপর মড়ার মতো পড়ে রইলেন।
এই দেশটি ছিল মধুমালার ভাটীনগর।
মধুমালা তাঁর সখীদের নিয়ে স্নান করতে এলেন নদীর ঘাটে। ঘাটের পাশে এক যুবককে মড়ার মতো পড়ে থাকতে দেখে সখীরা তাঁকে ধরাধরি করে ঘাটে আনল। এরপর কাদা-পলি ভালো করে ধুয়ে শুকনো কাপড় পরিয়ে দিল।
উভয়ের হাতে সেই আঙটি ছিল। মধুমালা দেখেই চিনতে পারলেন। মধুমালা গোঁসাঘরে গিয়ে খিল দিলেন। রাজা-রানি গোঁসাঘরের দ্বারে গিয়ে কন্যার মনের বাসনা জানতে চাইলেন। মধুমালা জানালেন—কুড়িয়ে পাওয়া এই যুবককে সে বিয়ে করতে চায়।
রাজা তখন আনন্দের সাথে মধুমালার সঙ্গে মদনকুমারের বিয়ে দিলেন। পরে মদনকুমারের পরিচয় পেয়ে রাজা আরও খুশি হলেন। সেখানে কয়েক মাস থাকার পর বাড়ি ফেরার জন্য মদনকুমারের মন খারাপ করতে লাগল।
দেশে ফেরার উপায় জানতে চাইলে মধুমালা বললেন, "আমার বাবা, রাজা বাসীকরের একটি হংসা পাখি আছে। এই হংসা পাখি তুমি চেয়ে নাও। আমরা এর পিঠে চেপে উড়ে যাব।"
তাই হলো। রাজার জামাতা মদনকুমারকে রাজা হংসা পাখিটি দান করলেন। হংসা পাখির পিঠে চেপে মধুমালা ও মদনকুমার উজানীর দিকে আকাশ পথে যাত্রা করলেন।
এদিকে মধুমালা ছিলেন পূর্ণগর্ভা। হংসা পাখি খুব বেগে উড়ে চলছে। কিছুদূর যাত্রার পর মধুমালার প্রসব বেদনা উঠল। মধুমালা বললেন, "হংসা, নিচে নামো, আমার প্রসব বেদনা উঠেছে।"
চারিদিকে জল। অবশেষে হংসা পাখি একটি চড়ার উপর নেমে পড়ল। সেখানে মধুমালা যমজ সন্তান প্রসব করলেন। একটির নাম চাঁদ আহতাব ও অন্যটির নাম মধুসূদন।
প্রসবের পর শীতে কাঁপতে লাগলেন মধুমালা। মদনকুমার আগুনের কোনো সন্ধান পেলেন না। হংসা পাখিকে আগুনের খোঁজে পাঠানো হলো। হংসা উড়ে গিয়ে এক নুলিয়ার ঘরে বন্দী হলো। চড়ার ওপর রইল দুই পুত্র নিয়ে মদনকুমার আর মধুমালা।
ঠিক সেই সময় ঠাঁট খাঁ নামে এক বণিক নদী পথে বাণিজ্যে গিয়ে পথ ভুল করে এখন বাড়ি ফিরছিল। তার বাড়ি ছিল চাঁট গাঁয়ে। তার নৌকায় যে সর্দার মাঝি ছিল, তার নাম দুলা মাঝি। দুলা মাঝি পরামর্শ দিল—মাস্তুলের উপর একটি লণ্ঠন জ্বালিয়ে ঝুলিয়ে রাখতে, যদি কেউ আলো দেখে আসে।
নৌকা যখন চড়ার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, তখন মধুমালা ও মদনকুমার ঐ আলো দেখতে পেলেন। মধুমালা মদনকুমারকে ঐ আলোর নিশানা ধরে যেতে বললেন।
মদনকুমার নৌকার নিকট এসে আগুন চাইলেন। চড়ায় অপরিচিত মানুষ দেখে দুলা মাঝি তাঁকে বণিকের নিকট নিয়ে গেল। বণিক মদনকুমারের পরিচয় জিজ্ঞাসা করল। মদনকুমার নিজের পরিচয় ও সবকিছু বললেন।
এই বণিক ভাটী নগরের কন্যা মধুমালারকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, কিন্তু তাঁর বাবা বিয়ে দেননি। সে মনে মনে ভাবল, 'এইবার পেয়েছি।' কিন্তু মুখে খুব সহানুভূতি দেখিয়ে বলল, "তোমার বাবা দণ্ডধর আমার বন্ধু। তুমি তোমার স্ত্রী-পুত্রকে নৌকায় নিয়ে এসো, আমি তোমাদের উজানীতে পৌঁছে দিয়ে চলে যাব।"
মদনকুমার একথা মধুমালাকে জানালে মধুমালা বললেন, "ঐ বণিককে বিশ্বাস করবেন না। হংসা পাখি ঠিক আসবে।"
মদনকুমার বললেন, "জোয়ার আসতে পারে, তাহলে এই চড়া ডুবে যাবে। বণিক ভালো লোক। চলো নৌকায় উঠি। বনের পাখি আর কি ফিরে আসবে!"
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মধুমালা মদনকুমারের সঙ্গে নৌকায় উঠলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর বণিক দুলা মাঝিকে ডেকে মদনকুমারকে নদীতে ফেলে দিতে বলল। মাঝি ফেলতে চাইল না। কিন্তু মধুমালার রূপ দেখে পাগল হয়ে গিয়েছিল বণিক। সে বলল, "যত টাকা চাই দেব, তবুও ফেলে দিতে হবে।" টাকার লোভে দুলা মাঝি জলে ফেলে দিল মদনকুমারকে।
মধুমালা তখন বললেন, "আমি বারণ করেছিলাম, কিন্তু তখন শোননি আমার কথা।"
মধুমালা তাঁর মাথার কাঁটাটা জলে ফেলে দিয়ে বললেন, "আমি যদি সতী হই, তবে এই কাঁটা আমার স্বামীকে রক্ষা করবে।"
কাঁটাটি একটা বড় কাঠ হয়ে মদনকুমারের সামনে ভেসে গেল। মদনকুমার সেটা ধরে ভেসে চললেন এবং স্ত্রী-র কথা না শুনে যে ভুল করেছেন, তা অনুধাবন করলেন।
কিছুক্ষণ পর বণিক দুলা মাঝিকে দিয়ে ছেলে দুটোকেও ফেলে দিতে চাইল। দুলা মাঝি রাজি হলো না। বণিক অনেক টাকা দিতে চাইল। তখন টাকার লোভে দুলা মাঝি ছেলে দু'টিকেও জলে ফেলে দিল।
মধুমালা তখন তাঁর মাথার দুটি চুল ছিঁড়ে জলে ফেলে দিয়ে বললেন, "আমি যদি সতী হই, তাহলে এই চুল দু'টি আমার পুত্রদের বাঁচাবে।"
চুল দু'টি বড় কাঠ হয়ে ছেলে দুটোর নিকট ভেসে গেল। ছেলে দুটো কাঠ দুটো ধরে ভেসে চলল।
তারপর বণিক মধুমালার নিকট গেল ও বিয়ে করতে চাইল। মধুমালা বললেন, "আমার বিশেষ ব্রত আছে। বারো বৎসর আমি বিয়ে করব না। বারো বৎসর পর বিয়ে করব। যদি বারো বৎসরের মধ্যে আমায় বিয়ে করো, তাহলে আত্মহত্যা করব।" বণিক আর কী করে, বারো বৎসর অপেক্ষা করতে লাগল।
এদিকে উজানীতে রাজা দণ্ডধর মারা গিয়েছেন। কে রাজা হবে, তাই নিয়ে ঝগড়া। রানির কথামতো রাজমন্ত্রী তেল সিঁদুর কপালে মাখিয়ে রাজহস্তীকে ছেড়ে দিল। তার পিঠে বেঁধে দিল সিংহাসন। ঐ হাতি শুঁড় দিয়ে যাকে তুলে পিঠের সিংহাসনে বসাবে, সেই হবে উজানীর রাজা।
এদিকে মদনকুমার কাঠ ধরে ভাসতে ভাসতে তীরে উঠে ভিখারির মতো চলতে লাগলেন। তিনি স্ত্রী ও পুত্রদের কথা ভুলে গেলেন, ভুলে গেলেন তিনি কে। এই ভাবে তিনি বিভিন্ন স্থান ঘুরতে লাগলেন।
রাজহস্তী ঘুরতে ঘুরতে তাঁকে পেল এবং শুঁড় দিয়ে তাঁকে তুলে পিঠের সিংহাসনে বসিয়ে উজানী নিয়ে গেল ও রাজা করল। রাজা হয়ে মদনকুমারের সব কথা মনে পড়ে গেল, কিন্তু অনেক খোঁজ করেও স্ত্রী বা পুত্রদের সন্ধান পেলেন না।
এদিকে মধুমালার দুই পুত্র চাঁদ আহতাব ও মধুসূদন কাঠ ধরে এক বনে গিয়ে উঠল। নদীর ধারে বনের কিনারায় পড়ে রইল তারা।
এক গোপের অনেক গাই ছিল। একজন রাখাল তাদের চরাত। গোপের একটি গাভী নদীতে জল খেতে এসে শিশু দু'টিকে দেখল ও তাদের মুখের নিকট বাঁট নিয়ে গেল। ছেলে দু'টি গাভীটির দুধ খেতে লাগল। প্রতিদিন ঐ গাইটা দুধ কম দিত, কারণ সে মধুমালার ছেলে দু'টিকে দুধ দিত। একদিন রাখাল ও গোপ গাভীর পিছু পিছু গিয়ে মধুমালার পুত্র দু'টিকে উদ্ধার করে আনল। গোপের বাড়িতে তারা মানুষ হতে লাগল।
তারা যখন একটু বড় হলো, তখন ছোট ভাই বড় ভাইকে বলল, "দাদা, এই গোপ কি আমাদের পিতা? না অন্য কেউ?" দাদা বলল, "এরা আমাদের মা-বাবা নয়। কে আমাদের মা-বাবা, চলো খোঁজ করি।"
এই বলে একদিন গোপ ও তার স্ত্রীর অগোচরে চাঁদ আহতাব ও মধুসূদন পিতা-মাতার খোঁজে চলে গেল। দুই ভাই হাঁটতে হাঁটতে এলো উজানী নগরে।
রাজা মদনকুমার উজানী নগরের উত্তরে নদী ও পথের মধ্যস্থলে একটি দীঘি কাটাচ্ছিলেন। বহু লোক সেখানে কাজ করছিল। পথশ্রমে কাতর দুই ভাই, অনেক দিন কিছু খায়নি। তারা এসে দীঘি কাটার কাজে লাগল।
রাজা একদিন দীঘি কাটার কাজ দেখতে এলেন। ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে রাজা চাঁদ আহতাব ও মধুসূদনকে দেখতে পেলেন। তাদের মুখের আদলে মধুমালার মুখের ছাপ ছিল। রাজা ছেলে দু'টির নিকট গিয়ে তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। তারা বলল, "কে আমাদের মা-বাবা জানি না। অমুক নদীর ধারে, বনের পাশে এক গ্রাম, এক গোপের ঘরে আমরা ছিলাম। তারা আমাদের মা-বাবা নয়। আমরা এখন মা-বাবার খোঁজে বেরিয়েছি।"
মদনকুমার বুঝলেন, এই নদীতেই তাঁকে ফেলে দিয়েছিল। এই ছেলেদের ফেলে দিয়েছিল দুষ্ট বণিক। কারণ এই ছেলেদের মুখে মধুমালার আদল। তাদের নিয়ে মদনকুমার রাজবাড়ি চলে গেলেন।
তারপর সাত নৌকা সাজিয়ে, সৈন্য সামন্ত নিয়ে মদনকুমার এবং চাঁদ আহতাব, মধুসূদন চলে গেলেন চাঁট গাঁ। চাঁট গাঁয়ের বণিককে যুদ্ধে পরাস্ত করে মধুমালাকে উদ্ধার করে আনলেন। বন্দী চাঁট খাঁ-কে মদনকুমার প্রাণদণ্ড দিলেন।
ওদিকে হংসা পাখি নুলিয়ার ঘরে বন্দী হয়েছিল। নুলিয়া তাকে কেটে খেতে চাইল। বন্দী হংসা বলল, "আমাকে তুমি কেটো না। আমার বরে বারো বৎসরের মধ্যে তোমাদের ঘরে পুত্র সন্তান আসবে।" এই নুলিয়া দম্পতি ছিল পুত্র-কন্যা হীন। কিন্তু বারো বৎসরের মধ্যে তাদের সন্তান হলো না। তখন ঠিক হলো হংসাকে কাটা হবে।
সেদিন বারো বৎসর পূর্ণ হয়েছে। হংসাকে কাটা হবে। হংসা নুলিয়াকে বলল, "ভাই, বারো বৎসর বন্দী হয়ে আছি, আকাশে ওড়ার শক্তি হারিয়েছি। আমাকে তো কেটে খাবেই। আমাকে একবার ছেড়ে দাও, আমি উঠানে একটু ঘুরে বেড়াই।"
হংসা পাখির কথামতো নুলিয়া হংসাকে ছেড়ে দিল। হংসা উঠানে হেঁটে বেড়াতে লাগল। আর যেই নুলিয়া অন্যমনস্ক হয়েছে, অমনি হংসা সাঁ সাঁ করে আকাশে উঠল। নুলিয়া জাল নিয়ে হংসার পিছু পিছু ছুটল, কিন্তু হংসার নাগাল পেল না।
হংসা উড়ে প্রথমে গেল সেই চড়ায়, তারপর ভাটী নগরে। কিন্তু সেখানে মধুমালা, মদনকুমার ও তাঁর পুত্রদের সন্ধান পেল না। তখন হংসা পাখি উড়ে গেল উজানী নগরে।
মধুমালার ব্রত ছিল—শত্রুর হাত হতে মুক্ত হলে সে দেবতার পূজা দেবে। সেদিন বারো বৎসর পূর্ণ হয়েছে। শত্রুর কবল হতে মুক্ত হয়ে স্বামী-পুত্র ফিরে পেয়েছেন মধুমালা। তাই দেবতার পূজা দিয়ে রাজপুরী ফিরে যাচ্ছিলেন।
হংসা পাখি মধুমালাকে দেখে নেমে পড়ল। হংসা তার দুঃখের কথা বলল। মধুমালা ও মদনকুমারও তাঁদের দুঃখের কথা জানালেন। এতদিনের দুঃখের অবসান হলো।
উজানী রাজসিংহাসনে বসলেন মদনকুমার ও মধুমালা। দু'পাশে বসলেন চাঁদ আহতাব আর মধুসূদন। আর হংসা পাখি দু'পাখা বিস্তার করে তাঁদের মাথায় ধরল ছাতা।
[ সংগৃহীত: বরিশালের শ্রী দীননাথ দাস এর নিকট হতে। ]
