চোরচক্রবর্তী রাজা | বাংলা সেরা রূপকথার গল্প

বাংলা ছোট গল্প লেখা

এক দেশে ছিল এক রাজা। উজির, নাজির, লোক-লস্করে রাজ্য জমজমাট। কিন্তু রাজার কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। তার ছিল দুটিমাত্র কন্যা। কন্যাদের রাজা খুব ভালোবাসতেন। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে মেয়ে-জামাইকে নিজের কাছে রেখেছেন তিনি। জামাইদেরও রাজা নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতেন।

একদিন রাজা রাজসভায় বসে সভাসদদের জিজ্ঞাসা করলেন, "কোন বিদ্যা বড়?" রাজার প্রশ্নের জবাবে কেউ বলে লেখাপড়া, কেউ বলে যুদ্ধবিদ্যা ইত্যাদি বড়। রাজার ছোট জামাই এই সব কথা শুনে বললে,

"চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা।

আর যদি পড়ে ধরা, তো জীয়ন্তোয় মরা।"

এই কথা শুনে মনে মনে রাজা ঠিক করলেন, চুরিবিদ্যা কেমন বড় তা একবার পরীক্ষা করে দেখতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সেদিন রাতে রাজ পোশাক ছেড়ে ছদ্মবেশ ধরে রাজা চুরি করতে গেল। রাজা একটা মাটি কাটা কোদাল নিয়ে রাজধানীর এক প্রজার বাড়িতে দেওয়ালে সিঁদ দিয়ে চুরি করতে গেল।

যে ঘরে রাজা সিঁদ দিচ্ছিল, সে ঘরের মালিক ও তার স্ত্রী মাটি কাটার শব্দ শুনে জেগে উঠল। রাজা যেই সিঁদ পথে ঘরে ঢুকেছে, অমনি তারা চোরকে ধরে ফেলল। তারপর চোরকে উত্তম মার দিল। মারের চোটে রাজা নিজের পরিচয় দিল। পরিচয় শুনে রাজাকে ছেড়ে দিয়ে চুরি করার কারণ শুধালো তারা। রাজা তখন সব কথা বলল।

জামাই-এর কথা পরখ করতে গিয়ে রাজা অপমানিত হলো, তাই রাগে, দুঃখে রাজা ছোট জামাই-এর প্রাণদণ্ড দিল। এই কথা শুনে ছোট মেয়ে বলল, তার জামাই যে তাকে বলেছিল "ধরা পড়লে জীয়ন্তে মরা" হবে। এই কথা শুনে কন্যার উপরও রাজা রেগে গেল। কন্যাকে রাজা বনবাসে দিল। রাজকন্যা তখন ছয় মাসের গর্ভবতী।

রাজা কন্যার হাতে তার শীলমোহরযুক্ত একটা লিখিত বার্তা লিখে দিল।

লিখিত বার্তা:

"চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা”— এই কথা তুমি না তোমার পুত্র অথবা কন্যা কোনোদিন যদি আমার নিকট প্রমাণ করতে পার, তাহলে সেদিন হতে এই লিখিত বার্তা বলে তুমি বা তোমার পুত্র অথবা কন্যা হবে এই রাজ্যের রাজা। আমি সেদিন স্বেচ্ছায় রাজ্য ছেড়ে দিয়ে চলে যাব।"

লিখিত বার্তা শেষে নিজের নাম দস্তখত করে, তাতে রাজকীয় শীলমোহর দিয়ে কন্যার হাতে দিল। কন্যাকে রাজ্যের নিকটবর্তী এক গভীর বনের মাঝে একটা পালকিতে চাপিয়ে রেখে এলো। স্বামীহারা বিধবা রাজকন্যা বনের মধ্যে পালকির উপর বসে কাঁদতে লাগল।

একাকিনী রাজকন্যা কমলা পালকির উপর বসে কাঁদছে, আর কাঁদছে। কান্না তার শেষ ছোঁয় না। কিছুক্ষণ পর এক কাঠুরে সর্দার বনে কাঠ কাটার জন্য সদলে এসে হাজির হলো। বিজন বনে, পালকির মধ্যে কান্নারত এক রূপবতী কন্যা দেখে তারা অবাক হয়ে গেল। সর্দার তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করল। কমলা সর্দারকে জানাল তার সব দুঃখের কথা।

কাঠ কাটা শেষে সর্দার তাকে নিজের বাড়ীতে নিয়ে এসে কন্যাস্নেহে পালন করতে লাগল। কিছুদিন পর কাঠুরের বাড়ীতে কমলা একটা পুত্র সন্তান প্রসব করল। যেমন নাক, তেমনি চোখ, গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁট, আর সুন্দর চেহারা দেখে সকলে খুব খুশী। কন্যাও পুত্র পেয়ে সব দুঃখ ভুলে গেল। তিলে তিলে সেখানে মানুষ হতে লাগল কমলার ছেলে।

ছেলে পাঠশালায় যায় আর কাঠুরে ছেলেদের সাথে খেলা করে। ছেলেটি একদিন কাঠুরে ছেলেদের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলা করছে। ছেলেটি সেজেছে পুলিশ আর কাঠুরের ছেলেরা সেজেছে চোর। শিশু বয়সে খেলাচ্ছলে চোর ধরে এমন ভাবে বিচার করছে যে, তার মধ্যে ফুটে উঠেছে রাজকীয়তা। বৃদ্ধ রাজা সেই পথ দিয়ে যেতে যেতে ছেলেটির খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। কিন্তু সে জানতে পারল না, এই ছেলে তার নির্বাসিত কন্যা কমলার ছেলে।

রাজা ছেলেটিকে তার পিতার নাম জিজ্ঞাসা করল। ছেলেটি উত্তর দিল, "জানি না।" খেলার সাথীরা এই কথা শুনে পাঠশালায় পড়তে গিয়ে সহপাঠীদের এই কথা বলে দিল। ছেলেরা সব বলে, "আমার পিতার নাম অমুক," কিন্তু কমলার ছেলে পিতার নাম বলতে পারে না।

মনের দুঃখে বাড়ি এসে, ছেলে মাকে সব কথা বলল। ছেলের কথা শুনে, ছেলেকে বুকে চেপে ধরে মা সব কথা বলে, ছেলেকে তার পিতার নাম বলে দিল। সব শুনে ছেলে চুরিবিদ্যা শিখতে চাইল। সে তার মাকে বলল, "এই চুরি বিদ্যা শিখে বাপের মৃত্যুর শোধ নেব।"

কাঠুরেরা যে গ্রামে বাস করত সেই গ্রামের পাশের গ্রামে ছিল এক চোরের সর্দার। সে এখন বৃদ্ধ। তাকে গুরু ধরে, তার নিকটে ছেলেটি চুরিবিদ্যা শিখতে লাগল। শৈশবে ছেলেটির মা ছেলেটির নাম রেখেছিল গোপাল। সে গুরুর কাছে নিষ্ঠার সঙ্গে চুরি বিদ্যা শিখতে লাগল।

এক বৎসর ধরে সে চুরি বিদ্যার প্রাথমিক বিদ্যা শিখে ফেলল। গুরু বলল, "বাবা গোপাল! আমার যা বিদ্যা সব তোমাকে শিখিয়েছি। আমাকে গুরু দক্ষিণা দিতে হবে।" গোপাল বলে, "কী দক্ষিণা দিব?"

গুরু বলল, "আগামী শনিবার অমাবস্যা। ঐ দিন রাতে আমি ঘরে শুয়ে থাকব। ঠিক আমার বুকের উপর ঝোলানো থাকবে বড় একটা কাঁসার থালা। থালায় থাকবে জল। জলের নীচে থালার মধ্যস্থলে থাকবে একটা রূপোর টাকা। এই টাকা এমনভাবে চুরি করতে হবে, যেন এক ফোঁটা জল গায়ে না পড়ে।" গোপাল বলল, "বেশ, তাই হবে গুরুদেব।"

গুরু চোর সর্দার শোবার আগে ঠিক তার বুকের উপর একটা থালা ঝুলিয়ে রাখল। রেখে দিল একটা রূপার টাকা। তারপর তাতে জল ঢেলে, ঠিক তার মধ্যস্থলে গুরু ঘুমিয়ে পড়ল।

গোপাল দরজার ফাঁকে আঙ্গুল চালিয়ে ধীরে ধীরে খিল খুলে, আরও ধীরে নিঃশব্দে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। গুরু তখন ঘুমে মগ্ন। সে কোঁচড়ে করে নিয়ে গিয়েছিল ছাই। সেই ছাই সে টাকার চারি পাশে হাতে করে দিয়ে দিল। জল শুষে গেল। অতি ধীরে টাকাটি তুলে ধীরে ধীরে দরজা লাগাল, খিলটি লাগিয়ে দিয়ে পালিয়ে এলো।

সকালে এসে গোপাল গুরুর চরণে টাকাটি রেখে প্রণাম করল। এই দেখে গুরু অবাক। গোপাল গুরুকে টাকা চুরির কথা শোনালো। গুরু শুনে বলল, "তুই বড় চোর হবি। তবে আমার বিদ্যা শেষ।"

গোপাল আরও ভালভাবে চুরি বিদ্যা শিক্ষার জন্য সেই পরগনায় যে বড় চোর তার নিকট গেল। এ চোর পূর্বের চোরের চেয়েও বড়। তবে সেও বুড়ো হয়েছে। গোপালকে সে চৌর্য মন্ত্র দিয়ে চুরি শেখাতে লাগল।

এক বৎসর ধরে গোপাল তার নিকট চৌর্য বিদ্যার নানা কলা কৌশল শিখল। শিক্ষা শেষ হলে গুরু শিষ্যের নিকট গুরু দক্ষিণা চাইল। এবারের গুরু দক্ষিণা হলো: গাছের ডালে চিল বসে ডিমে তা দেবে। গাছে উঠে সেই তা-দেওয়া ডিম তুলে আনতে হবে। ডিম এমনভাবে আনতে হবে, চিল যেন জানতে না পারে।

বনের ধারে গাছের ডালে ছিল চিলের বাসা। একটা চিল সেখানে বসে ডিমে তা দিচ্ছিল। গোপাল কালিঝুলি মেখে সারা গায়ে পাতা যুক্ত লতা জড়িয়ে ধীরে ধীরে চিলের বাসার পিছনে গিয়ে নিঃশব্দে বসল। তারপর দুটি আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিল অতি ধীরে। সেই দুটি আঙ্গুলে তুলে আনল একটা ডিম। চিল তায়ে বসে থাকল, কিছুই জানতে পারলো না। সেই ডিম গুরুর হাতে দিল। গুরু ডিমটা সিদ্ধ করে খেতে বলে দিল। গুরু বলল, "তুমি হবে সবচেয়ে বড় চোর।" গুরু শিষ্যকে বলল, "আমার বিদ্যা শেষ।"

গোপাল আরও চুরিবিদ্যা শিখতে চাইল। ঐ গুরু বলল: "এখান থেকে পঞ্চাশ ক্রোশ দূরে আছে এক শহর। সেই শহরে আছে এক অতি বৃদ্ধ চোর। সে যাকে তাকে বিদ্যা শেখায় না।" পরগণার চোর তাকে একটা লিখিত বার্তা লিখে দিল। সেই লিখিত বার্তা নিয়ে গোপাল গিয়ে হাজির হলো সেই বৃদ্ধ চোরের কাছে। বৃদ্ধ চোর সব শুনে তাকে চৌর্যবিদ্যা শিক্ষা দিতে শুরু করল।

পাঁচ বৎসর ধরে সে নিষ্ঠার সঙ্গে চুরি বিদ্যা শিখল। শিক্ষা শেষে পরীক্ষা ও গুরু দক্ষিণা। এবারের দক্ষিণা থালা হতে টাকা বা তা-দেওয়া ডিম চুরি নয়। এ পরীক্ষা কঠিন। সেই শহরে ছিল এক জাগ্রত ডাকাতে কালী। এই কালীর একটা মানসিক পাঁঠা ছিল। গুরু বলল, "এই পাঁঠা এমন ভাবে চুরি করে কেটে খেতে হবে যে, মা কালী যেন জানতে না পারে।"

প্রথম পর্ব সমাপ্ত


পরবর্তী পর্ব পড়ুন

Post a Comment