আপাং ও দুলাং

শিক্ষনীয় কষ্টের গল্প


এক দেশে ছিল এক রাজা। তার হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া। লোক-লস্কর, চাকর-বাকর নানা কাজে ছোটাছুটি করছে। উজির, নাজির সকলে সব দেখাশুনা করছে। রাজা বয়সে তরুণ। তার একমাত্র রূপবতী বউ, নাম তার আদুরী। রাজার ঔরসে আর আদুরীর গর্ভে দুটো সুন্দর ছেলে হয়েছে। রাজা-রাণী আদর করে ছেলে দুটোর নাম রেখেছে আপাং আর দুলাংদুলাং একটু বড় আর আপাং ছোট। সুন্দরী স্ত্রী, সুন্দর সুন্দর দুই ছেলে—আপাং আর দুলাং আর রাজ্য নিয়ে রাজা বেশ সুখে আছে।

একদিন রাজা কাজ সেরে বাড়ি ফিরে দেখছে—আদুরী বিছানায় শুয়ে আছে। গায়ে তার খুব জ্বর। রাজার পরিবারের অসুখ। এলো বৈদ্য, রোজা, হেকিম। কিন্তু জ্বর ভালো হয় না। এমনি করে আদুরী কঠিন অসুখে পড়ল। একদিন আদুরী রাজাকে ডেকে বলছে, "দেখ রাজা, আমি আর বাঁচব না। আমাদের আদরের দুলাল আপাং আর দুলাং থাকল। আর একটা অনুরোধ, তুমি আর বিয়ে কোরো না।" রাজা বললে: "না আদুরী, তুমি মরে গেলে আমি আর বিয়ে করবো না।"

কিছুদিন পর রাণী আদুরী মরে গেল। রাজবাড়ীর যে ধাই-মা ছিল, সে আপাং, দুলাংকে মানুষ করতে লাগল। আপাং আর দুলাং রাজার দুই নয়নের মণি। রাজা তাদের চোখের আড়াল করে না। তাদের পড়ানোর জন্য এক পণ্ডিত ঠিক করলো রাজা। এই ভাবে দিন যায়।

একদিন উজির রাজাকে বলছে, "মহারাজ! ঘর সংসারে স্ত্রী না থাকলে মানায় না। আপনি আর একটা বিয়ে করুন।" রাজা বলে, "না উজির, আমি আদুরী রাণীর সঙ্গে সত্যবদ্ধ করেছি—বিয়ে করবো না। আপাং-দুলাং আছে আদরের ধন, তাদের নিয়ে থাকবো।" উজির তখন রাজার কথা শুনে বলছে, "মহারাজ, বিয়ে না করলে কষ্ট হবে আপনার। তাছাড়া আপাং-দুলাং-এর কোনো কষ্ট হবে না। যে রাণী হয়ে আসবে তার তো ছেলে নাই। সুন্দর এই আপাং-দুলাংদের দেখে নতুন রাণীর মায়া বসে যাবে।"

বার বার উজিরের কথা শুনে রাজা বিবাহে রাজি হলো। অন্য দেশের এক রাজার, এক সুন্দরী কুমারী কন্যা ছিল। তার সঙ্গে বিয়ের ঠিক হলো। আপাং, দুলাং বাপের সঙ্গে যেতে চায়। উজির বলে, "না, ছেলেদের নিয়ে যাওয়া হবে না। কি জানি, ছেলে দেখে রাজা যদি তার মেয়ের বিয়ে না দেয়।"

রাজা বিয়ে করতে চলে গেল। আপাং, দুলাং ধাই-মায়ের কাছে বাড়িতে থাকল। পরদিন বিয়ে করে রাজা আসছে পালকিতে চড়ে, আসছে নতুন রাণী। ছোট ছেলে আপাং নতুন মা দেখতে ছুটে যেতে চায়। বড় ভাই দুলাং যেতে দেয় না। আপাং তবু যেতে চায়। শেষে আপাং যেই ছুটে পালকির কাছে গিয়েছে, নতুন রাণী শুধালো, "এ ছেলেটা কে?" চাকরে বলছে, "রাজার প্রথম রাণীর ছোট ছেলে।" অমনি রাণী পালকি হতে তার বুকে মারল এক লাথি। আপাং পড়ে গেল ধূলায়। দুলাং ছুটে এসে ভাইকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, "যেতে বারণ করলাম, তবু গিয়ে অপমানিত হলি!"

এদিকে রাজার সঙ্গে যে মেয়ের বিয়ে হলো, সে মেয়ে খারাপ। যুবতীকালে রাজ বাড়ীর তরুণ দারোয়ানের সঙ্গে তার ভালোবাসা হয়। বিবাহ শেষে যুবতীর পিতা যখন তাকে শুধালেন, "মা, তোমার কি চাই?" মেয়ে তখন বাবাকে বলছে, "বাবা! আমার চাই একটা বড় সিন্দুক, তাতে লাগানো থাকবে চারটি চাকা। তার মধ্যে আমি সব কিছু ভরে নিয়ে যাব।" রাজার মেয়ের কথামতো চাকাওয়ালা একটা সিন্দুক বানিয়ে দিলো। তার মধ্যে সযত্নে দারোয়ানকে ভরে, সে নিয়ে গেল স্বামীর ঘরে।

রাজা যখন রাজ কাজে যায়, আপাং, দুলাং যখন পড়তে যায়, তখন সিন্দুক খুলে দারোয়ানকে বার করে। তারপর খায়-দায় এক সঙ্গে বিছানায় শোয়।

একদিন দুলাং পাঠশালে পড়তে গিয়েছে, আপাং তার বয়সী ছেলেদের সাথে সোনার ভেঁটুল নিয়ে খেলা করছে। খেলতে খেলতে সবকটা সোনার ভেঁটুল হেরে গেল আপাং। হেরে সে কাঁদতে লাগল। কান্না শুনে দুলাং ছুটে এল। ভেঁটুল হারার কথা শুনে ছেলেদের কাছে সে ভেঁটুল চাইল। তারা বলল, "ভেঁটুল জিতেছি, দেব না।"

দুলাং তখন ভেঁটুল আনতে অসময়ে বাড়ি ফিরে গেল। গিয়ে দেখে সিন্দুক খোলা, দারোয়ান আর নতুন মা এক সঙ্গে বিছানায় শুয়ে আছে। গায়ে তাদের চাদর। ঘুমিয়ে গেছে তারা। দুলাং তখন তার চাদরটা তাদের গায়ে দিয়ে, তাদের চাদরটা তুলে নিয়ে চলে গেল।

ঘুম হতে উঠে রাণী চাদর বদলের কথা জানতে পারল। দারোয়ানকে সে ঢুকিয়ে দিল সিন্দুকের মধ্যে। নেড়েচেড়ে চাদরটি দেখে, মনে মনে বলল, "এ চাদরতো দুলাং-এর গায়ে দেখেছি।" দুলাং এসব কথা কাউকে বলে না। রাণী তার সৎ ছেলেদের প্রতি হিংসাপরায়ণ হয়ে উঠল।

একদিন রাণী চুল এলোমেলো করল, সারা গায়ে পাখির রক্ত মাখল, তারপর ঘরের দাওয়ায় বসে কাঁদতে লাগল। এই সব দেখে ঝি রাণীকে শুধায়, "কি হয়েছে?" রাণী বলে, "সৎ ছেলেরা খেতে চেয়েছিল, দিতে একটু দেরী হয়েছিল, তাই তারা দুই হাতে আমাকে মেরেছে।" ঝি গিয়ে রাজাকে সব কথা বলল। রাজা বাড়ি এসে রাণীর অবস্থা দেখে খুব রেগে গেল এবং আপাং, দুলাংকে কঠিন শাস্তি দিতে চাইল।

যে ধাই ছেলে দুটিকে মানুষ করেছিল, সে ছুটে পাঠশালে পণ্ডিতের কাছে গিয়ে সব বলল। ধাই অনুরোধ করল পণ্ডিতকে যে এ যাত্রা যেন নিজে ছেলে দুটি সঙ্গে করে রাজার কাছে নিয়ে গিয়ে রক্ষা করে। পণ্ডিত আপাংদুলাংকে সঙ্গে করে রাজার নিকট নিয়ে গিয়ে বলল, "মহারাজ, পাঠশালায় পড়ছিল, কোথাও যায় নি; এ যাত্রা ওদের মাফ করুন।" রাজা বলল, "এ যাত্রা আপনার কথামতো ছেড়ে দিলাম। ভবিষ্যতে যদি এই রকম কাজ করে, তাহলে কঠিন শাস্তি দেব।"

দিন যায়। রাণী মনে মনে ভাবে, "শত্রু দুটোকে যে করেই হোক সরাতে হবে।" আবার রাণী চুল এলোমেলো করল, যেন তাকে ছিঁড়ে দিয়েছে। গায়ে মাখল ধূলোবালি কাদা। তার উপর ছিটালো পাখির রক্ত। ঝি আবার দেখল। শুনে রাজার নিকট গিয়ে সব বলল। রাজা বাড়ি এসে দেখে রাগে অগ্নিশর্মা হলো। বলল, "আজ দুই ছেলেকে জল্লাদ দিয়ে খুন করাব। তারপর সেই রক্ত দিয়ে তোমার পায়ে আলতা পরিয়ে দেব, আর কপালে দেব ফোঁটা।"

ধাই সব শুনল। তারপর সে একটা লিখিত বার্তা তার বিশ্বাসী লোকের নিকট দিয়ে লিখে এনে রাজ বাড়ীর দরজায় টাঙিয়ে দিল।

লিখিত বার্তা:

আপাং ও দুলাং, তোমরা এই বার্তা পড়ে যেদিকে তোমাদের দু'চোখ যায়, সেই দিকে চলে যাবে। তোমাদের সৎমা চুল ছিঁড়ে ধূলোকাদা, পাখির রক্ত মেখে তোমাদের বাবাকে দেখিয়ে বলেছে যে, তোমরা দুই জনে তাকে মেরেছ। তাই তোমাদের বাবা তোমাদের খুন করার জন্য বাড়িতে বসে আছে।

ইতি—ধাই-মা।

পাঠশালের পড়া শেষ করে দু'ভাই মনের আনন্দে বাড়ি ফিরছে। খুব খিদে পেয়েছে, ভাত ইত্যাদি খাবে। কিন্তু বাড়ি ঢুকতে দেখে দুয়ারে টাঙানো 'লিখিত বার্তা'। বার্তা পড়ে দুলাং ভাই, জনমের মত আপাংকে বলল, "ভাই, আর থাকা হবে না; এখনি পালাতে হবে, নচেৎ প্রাণ যাবে।" আপাং বলছে: "চলে যাচ্ছি, একবার বাপের মুখ দেখবো।" দুলাং বলছে, "না। দেখা হলে আর রক্ষা নাই।" কিন্তু ছোট ভাই কিছুতেই শোনে না। তখন দুলাং আপাংকে কাঁধে নিয়ে জানালা পথে বাবাকে দেখালো। দেখার সঙ্গে সঙ্গে বাবার চোখে চোখ পড়ে গেল। দুই ভাই ধরা পড়ে গেল। রাজার হুকুমে দু'ভাইকে দড়ি দিয়ে বাঁধা হলো।

শহরের শেষে শ্মশান। তার পাশে মশান। সেখানে দু'ভাইকে নিয়ে যাওয়া হলো। জল্লাদ একে একে দুই ভাইকে কাটতে গেল। দুলাং বলছে, "ভাই জল্লাদ, আমাদের দু'ভাইকে এক সঙ্গে কাট। কারণ আমাকে যদি আগে কাট, আপাং দেখতে পারবে না। আপাংকে যদি আগে কাট, আমি দেখতে পারবো না।"

বাঁধ বাঁধ জল্লাদ ভাই একই দড়িতে আপাং আর দুলাংকে।

কাট কাট জল্লাদ ভাই একই চোটে আপাং আর দুলাং-কে।

সে বলল, "এই গান ও কান্না শুনে জল্লাদের মনে দয়া হলো। আপাং আর দুলাং, তোমাদের মায়ের হাতে অনেক নিমক খেয়েছি। তোমাদের এই শর্তে ছেড়ে দিতে পারি যে, তোমরা এই দেশ ছেড়ে চলে যাবে। আর এদেশে আসবে না।"

তাই হলো, আপাং আর দুলাং দেশ ছেড়ে দেশান্তরে চলে গেল। জল্লাদ একটা কুকুরের ছানা মেরে মাটির কোটরায় করে রক্ত নিয়ে রাজাকে দিল। রাজা তা দিল রাণীকে, আর রাণী তা দিয়ে পায়ে আলতা ও কপালে ফোঁটা নিল।

ছাড়া পেয়ে জল্লাদের গুণ গাইতে গাইতে আপাং আর দুলাং চলে যাচ্ছে বাপের রাজ্য ছেড়ে। কয়দিন হাঁটার পর আপাং কাতর হয়ে গেছে। আর হাঁটতে পারছে না। তাই দেখে দুলাং তখন আপাংকে বলছে:

চল চল আপাং রে এ দেশ থেকে চলে।

সতীন কাঁটা বড় লেঠা,

কোন্ দিন ফেলবে ভাইরে মেরে।

চল চল আপাং রে আমরা যাইগো দেশান্তরে।

আপাং আর দুলাং মনের দুঃখে দেশ ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেল। আর রাণী বলল, "আর দুঃখ নাই।" সে মনের আনন্দে দারোয়ানকে নিয়ে কু-কাজ করতে লাগল।

আপাং আর দুলাং তার বাপের রাজ্য ছেড়ে অনেক দূরে আর এক রাজার রাজ্যে এসে হাজির হলো। দেখলো সামনে এক বিরাট শহর। শহর ঢোকার মুখে এক বিরাট দীঘি। তারা গিয়ে দীঘির পাড়ে এক বট গাছের ছায়ায় বসল। কিছুক্ষণ পর এক ঘোড়ার কোচোয়ান সেখানে এলো দল কাটতে। কোচোয়ান দল কাটল।

দুলাং তার কাছে গিয়ে বলল, "ভাই আমরা বিদেশী। তোমার সঙ্গে দল কাটবো, তুমি যা দেবে, তাই খাবো আর তোমার সাথে থাকবো। আর তোমার এই কাটা দল দাও আমরা মাথায় করে নিয়ে যাই।" কোচোয়ান দেখল, ছেলে দুটি দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি ব্যবহার। তাই সে তাদের ভালোবেসে ফেলল। বলল, "তোমাদের দল নিয়ে যেতে হবে না। আমি দল নিয়ে যাবো। চল, তোমরা আমার নিকট থাকবে। আমি যা খাবার পাবো তা তিনজনে ভাগ করে খাবো।"

আপাং আর দুলাং এখন কোচোয়ানের নিকট থাকে। মাঝে মাঝে তার কাজ করে দেয়। এই কোচোয়ান এক সদাগরের ঘোড়া দেখাশুনা করে। সদাগর দেশে সওদাগরি করে বেড়ায়। রাজার সে ডান হাত। কিন্তু সদাগরের মনে সুখ নাই। তার ছেলেপিলে নাই, একমাত্র সুন্দরী কন্যা কিন্তু তার পেটের অসুখ। পেট কনকন করে। কেউ ভালো করতে পারে না। অনেক অনেক কবিরাজ, বৈদ্য এলো, কেউ কিছু করতে পারে না। আপাং আর দুলাং এই অসুখের কথা শুনল।


একদিন দুলাং সেই কোচোয়ানকে বলল, "ভাই, আমি একবার মেয়েটিকে দেখতে চাই। তুমি একবার সদাগর ও তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা কর আমাকে দেখতে দেবে কিনা?" সদাগর আর তার স্ত্রী কোচোয়ানের মুখে কথা শুনে বলল, "নিশ্চয় দেখতে দবো। যদি ভালো করতে পারে, বহু টাকা ইনাম দেব।"

দুলাং তখন সদাগর কন্যাকে দেখতে গেল। দেখে সে বলল, "এই কন্যাকে সারারাত পাহারা দিতে হবে।" আর সে চাইল এক পোয়া ঘি, আর সাত মুখ যুক্ত প্রদীপ। প্রদীপের উপর ঘি ঢেলে দিয়ে সাতটি বাতি জ্বালিয়ে দিল দুলাং। তলোয়ার হাতে দুলাং বসে থাকে।

এদিকে কন্যার পেটে বাস করে এক সাপ। সুতোর মতো সরু হয়ে নাক দিয়ে ঢোকে আর সুতোর মত সরু হয়ে নিশিভোর রাতে বেরিয়ে চরচিরে শব্দ করে। তারপর আবার এসে ঢোকে নাক দিয়ে। এর জন্য কন্যার পেট কনকন করে, ভালো হয় না। নিশিভোর রাতে সেদিন সাপ যেই বেরিয়েছে অমনি প্রদীপের আলোয় কানা হয়ে গিয়েছে। আর তলোয়ার দিয়ে সাপকে খণ্ড খণ্ড করে কেটে ফেলেছে দুলাং। এই সাপ মাটিতে পড়লেই মোটা হয়। সাপ মারা পড়ল। কন্যা বহু দিন পর বেঘোর ঘুমাল। দুলাং তাকে জাগাতে বারণ করল।

দুলাং-এর চেহারা আর কাজ দেখে সদাগর ও তার স্ত্রী খুব খুশী হলো। সদাগর কন্যার সঙ্গে দুলাং-এর বিয়ে দিল তারা। আপাং আর দুলাং সদাগরের বাড়ীতে সুখে বাস করতে লাগল। এই ভাবে দিন যায়।

সদাগর ঠিক করল সে বাণিজ্য করতে যাবে। দুলাং বলল, "আপনি বুড়ো হয়েছেন, কষ্ট হবে, বাণিজ্য করতে আমি যাই আপনার সঙ্গে।" তাই ঠিক হলো। যাত্রার আগে দুলাং তার স্ত্রীকে বলল, "আপাং থাকল তোমার জিম্মায়। আমার চোখের মণি, আদরের ছোট ভাই। একে ঠিকমতো যত্ন করে রেখো।" স্ত্রী বলল, "তাই হবে।" দুলাং সদাগরের সঙ্গে বাণিজ্যে চলে গেল।

এদিকে আপাং আর দুলাং-এর বাপ, সেই রাজা, রাতে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে যে আপাং আর দুলাং তার দুই ছেলে সমুদ্রে সাঁতার কাটছে। চেষ্টা করেও রাজা তাদের ধরতে পারছে না। ঘুম হতে জেগে মা-মরা দুই পুত্রের জন্য রাজা কাঁদতে লাগল।

কোথা গেলি ওরে আমার আপাং-দুলাং।

তোদের সৎ মায়ের কথা শুনে,

পাঠালাম শ্মশানে,

বুঝতে পারলাম না ছলাকলা।

কোথা গেলি ওরে আমার আপাং-দুলাং।

তারপর জল্লাদকে বলল, "ভাই জল্লাদ, আমাকে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে যে ভাবে আমার দুই ছেলেকে কেটেছিস, সেই ভাবে আমাকে কাট। পুত্র শোক আমি ভুলতে পারছি না।"

তখন জল্লাদ রাজাকে বলছে; "মহারাজ, আপনার দুই পুত্রকে আমি কাটি নাই। তারা ফকিরের বেশে দেশান্তরে চলে গিয়েছে।" রাজা বলছে, "তাহলে তাদের ফেরানোর উপায় কি?" জল্লাদ তখন রাজাকে বলছে, "মহারাজ! আপনি দেশে দেশে ঢেঁড়া দিয়ে প্রচার করুন যে, যারা দুঃখী, গরীব, ফকির, তাদের অমুক দেশের বাদশা দান করবেন—কাপড়, টাকা-কড়ি ইত্যাদি, তাহলে আপনার ঐ দুই ছেলে ফিরে আসবে। কারণ তারা তো এখন ফকির।"

দেশে দেশে এই কথা রটনা হতেই, ফকির, গরীব, দুঃখীর দল রাজার রাজধানীতে আসতে লাগল। একদিন আপাং দেখছে অনেক ফকির পথ দিয়ে কোথায় যাচ্ছে। সে ফকিরদের শুধালো, "ভাই তোমরা কোথায় যাচ্ছ?" ফকিররা বলল, "অমুক দেশের বাদশা অনেক দান করবে, সেই দান আনতে যাচ্ছি।" ফকিরদের সঙ্গে এই দান দেখতে যেতে সে ইচ্ছা করল; আর এ কথা সে তার ভাবীকে জানাল। ভাবী বলল, "যাওয়া হবে না।" স্বামীর নির্দেশের কথা তার মনে পড়ে গেল। আপাং কিছুতেই বারণ মানে না।

কথা শুনে ভাবী যেই অন্যমনস্ক হয়েছে অমনি সে অন্য একদল ফকিরের সাথে মিশে রাজার দান দেখতে গেল। জল্লাদের কথামতো সব ফকিরকে খেতে দিয়ে তাদের এক বড় ঘরে আটক করে রাখা হলো। এদের মধ্যে কে আপাং-দুলাং তা খুঁজতে হবে। এই ভাবে প্রতিদিন ফকির আটক করতে লাগল রাজা।

এদিকে বাণিজ্য শেষ করে দুলাং ফিরে এসেছে। ভাইকে দেখতে না পেয়ে তার কথা স্ত্রীকে শুধালো। স্ত্রী সব কথা বলল। শুনে স্ত্রীর উপর দুলাং-এর খুব রাগ হলো। স্ত্রী বলল, "আমার কোন দোষ নাই।"

দুলাং তখন ফকিরের ছদ্মবেশে কাঁধে ঝোলা নিয়ে নোংরা কাপড় পরে হাতে একটা ডুবকি নিয়ে পিতার রাজ্যে এসে গেল। রাজবাড়ীর দুয়ারে গিয়ে সে গান গাইতে লাগল:

আমার হাতে ডুবকি, কাঁধে ঝোলা,

এক বাদশা গেল বিয়ে করতে, করি আমি গান।

কি কি পেল দান।

দান আনে সেই বাদশার নারী,

এসে হলো গোসা ভারী,

আপাং আর দুলাং-এ রাজা দিল বলিদান।

গান শুনে রাজা তখন ভাবছে, "আমিই তো সেই বাদশা।" কারণ আপাং-দুলাং-এর নাম আছে গানে। রাজা তখন তার নতুন বিবিকে বলছে:

আনো চাবি, খুলবো সিন্দুক, দেখবো কিবা আছে,

তোমার কথায় খুন করেছি আপাং আর দুলাংকে।

গান শুনে রাণী বলছে:

চাবি তো নাই আমার কাছে, হারিয়ে গেছে চাবি,

আপাং-দুলাংকে ডাকো, এই কথা আজ ভাবি।

চালের বাতায় ছিল চাবি, চাবি নিল চোরে,

কপাল আমার ভেঙে গেল, পড়লাম বিপদ ঘোরে।

এলো বিপদ, খাটল না মোর কোন ছলাকলা।

এ গোল আমার লাগিয়ে গেল আপাং আর দুলাং।

চাবি না পেয়ে রাজা সিন্দুকে মারে লাথি। সিন্দুকের ডালা ভেঙে গেল। বেরিয়ে পড়ল, রাণীর প্রেমিক দারোয়ান। সিন্দুক সমেত তাকে পুঁতে ফেলা হলো। সব ফকিরকে ছেড়ে দেওয়া হলো। ফকির দল হতে আপাং এলো বড় ভাই দুলাং-এর কাছে। বাপ তাদের দু'জনকে জড়িয়ে ধরল।

রাজা তখন রাণীর বিচারের ভার দিল দুলাং-এর হাতে। দুলাং বলল, "আমাদের মা মরে গিয়েছে; আর একে যখন একবার মা বলেছি, তখন এ মা হয়ে থাক।" বাপ বলল, "না, যখন আমার স্ত্রী আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তখন একে পাঠিয়ে দাও বাপের বাড়ি।"

তাই হলো। শুভ দিন দেখে রাজা পুত্রবধূকে নিয়ে এলো। সকলে সুখে বাস করতে লাগল।

[আমার দাদিমা (গুলনাহার বেগম, ভোলা জেলা) থেকে সংগ্রহ করা]

Post a Comment