ঘুমন্ত পুরী । সেরা রূপকথার গল্প বাংলা

রূপকথার গল্প লিখিত

এক দেশের এক রাজপুত্র। রাজপুত্রের রূপে রাজপুরী আলো। রাজপুত্রের গুণের কথা লোকের মুখে ধরে না।

একদিন রাজপুত্রের মনে হইল, দেশভ্রমণে যাইবেন। রাজ্যের লোকের মুখ ভার হইল, রাণী আহার নিদ্রা ছাড়িলেন, কেবল রাজা বলিলেন, "আচ্ছা, যাক্।”

তখন দেশের লোক দলে- দলে সাজিল,

    রাজা চর - অনুচর দিলেন,

    রাণী মণি - মাণিক্যের ডালা লইয়া আসিলেন।

রাজপুত্র লোকজন, মণি-মাণিক্য চর-অনুচর কিছুই সঙ্গে নিলেন না। নূতন পোষাক পরিয়া, নূতন তরোয়াল ঝুলাইয়া রাজপুত্র দেশভ্রমণে বাহির হইলেন।

যাইতে যাইতে যাইতে যাইতে, কত দেশ, কত পর্বত, কত নদী, কত রাজার রাজ্য ছাড়াইয়া, রাজপুত্র এক বনের মধ্যে গিয়া উপস্থিত হইলেন! দেখেন, বনে প'খ-পাখালীর শব্দ নাই, বাঘ-ভালুকের সাড়া নাই! রাজপুত্র চলিতে লাগিলেন!

চলিতে চলিতে, অনেক দূর গিয়া রাজপুত্র দেখেন, বনের মধ্যে এক যে রাজপুরীর সীমা। অমন রাজপুরী রাজপুত্র আর কখনও দেখেন নাই! দেখিয়া রাজপুত্র অবাক হইয়া রহিলেন।

রাজপুরীর ফটকের চূড়া আকাশে ঠেকিয়াছে। ফটকের দুয়ার বন জুড়িয়া আছে। কিন্তু ফটকের চূড়ায় বাদ্য বাজে না, ফটকের দুয়ারে দুয়ারী নাই। রাজপুত্র আস্তে আস্তে রাজপুরীর মধ্যে গেলেন!

রাজপুরীর মধ্যে গিয়া দেখেন, পুরী যে পরিষ্কার, যেন, দুধে ধোয়া, ধব্ ধব করিতেছে। কিন্তু এমন পুরীর মধ্যে জন-মানুষ নাই, কোন কিছুর সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না, পুরী নিভাঁজ, নিঝুম - পাতাটি পড়ে না, কূটাটুকু নড়ে না। রাজপুত্র আশ্চর্য হইয়া গেলেন।

রাজপুত্র এদিক দেখেন, ওদিক দেখেন পুরীর চারিদিক দেখিতে লাগিলেন। একখানে গিয়া রাজপুত্র থমকিয়া গেলেন! দেখেন, মস্ত আঙ্গিনা, আঙ্গিনা জুড়িয়া হাতী, ঘোড়া, সেপাই, লস্কর, দুয়ারী, পাহারা, সৈন্য, সামন্ত সব সারি সারি দাঁড়াইয়া রহিয়াছে!

রাজপুত্র হাঁক দিলেন! কেহ কথা কহিল না, কেহ তাঁহার দিকে ফিরিয়া দেখিল না।

অবাক হইয়া রাজপুত্র কাছে গিয়া দেখেন, কাতারে কাতারে সিপাই, লস্কর, কাতারে কাতারে হাতী ঘোড়া সব পাথরের মূর্তি হইয়া রহিয়াছে। কাহারও চক্ষে পলক পড়ে না কাহারও গায়ে চুল নড়ে না। রাজপুত্র আশ্চর্য হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।

তখন রাজপুত্র পুরীর মধ্যে গেলেন।

এক কুঠরীতে গিয়া দেখেন, কুঠরীর মধ্যে কত রকমের ঢাল তরোয়াল, তীর, ধনুক সব হাজারে হাজারে টানানো রহিয়াছে। পাহারারা পাথরের মূর্তি, সিপাইরা পাথরের মূর্তি। রাজপুত্র আপনার তরোয়াল খুলিয়া আস্তে আস্তে চলিয়া আসিলেন।

আর এক কুঠরীতে গিয়া দেখেন, মস্ত রাজদরবার, রাজদরবারে সোনার প্রদীপে ঘিয়ের বাতি জ্বল্ জ্বল্ করিতেছে, চারিদিকে মণি- মাণিক্য ঝকঝক্ করিতেছে। কিন্তু রাজসিংহাসনে রাজা, পাথরমূর্তি, মন্ত্রীর আসনে মন্ত্রী পাথরমূর্তি, পাত্র মিত্র ভাট বন্দী, সিপাই লস্কর যে যেখানে, সে সেখানে পাথরমূর্তি। কাহারও চক্ষে পলক নাই, কাহারও মুখে কথা নাই। -

রাজপুত্র দেখেন, রাজার মাথায় রাজছত্র হেলিয়া আছে, দাসীর হাতে চামর ঢুলিয়া আছে, সাড়া নাই, শব্দ নাই, সব ঘুমে নিঝুম। রাজপুত্র মাথা নোয়াইয়া চলিয়া আসিলেন।

আর এক কুঠরীতে গিয়া দেখেন, যেন কত শত প্রদীপ একসঙ্গে জ্বলিতেছে-কত রকমের ধন রত্ন, কত হীরা, কত মাণিক, কত মোতি, কুঠরীতে আর ধরে না। রাজপুত্র কিছু ছুঁইলেন না; দেখিয়া, আর এক কুঠরীতে চলিয়া গেলেন।

সে কুঠরীতে যাইতে-না- যাইতে হাজার হাজার ফুলের গন্ধে রাজপুত্র বিভোর হইয়া উঠিলেন। কোথা হইতে এমন ফুলের গন্ধ আসে? রাজপুত্র কুঠরীর মধ্যে গিয়া দেখেন, জল নাই টল নাই, কুঠরীর মাঝখানে লাখে লাখে পদ্মফুল ফুটিয়া রহিয়াছে! পদ্মফুলের গন্ধে ঘর ম-ম করিতেছে। রাজপুত্র ধীরে ধীরে ফুলবনের কাছে গেলেন।

ফুলবনের কাছে গিয়া রাজপুত্র দেখেন, ফুলের বনে সোনার খাঁট, সোনার খাটে হীরার ডাঁট, হীরার ডাঁটে ফুলের মালা দোলান রহিয়াছে; সেই মালার নীচে, হীরার নালে সোনার পদ্ম, সোনার পদ্মে এক পরমা সুন্দরী রাজকন্যা বিভোরে ঘুমাইতেছেন। ঘুমন্ত রাজকন্যার হাত দেখা যায় না, পা দেখা যায় না, কেবল চাঁদের কিরণ মুখখানি সোনার পদ্মের সোনার পাঁপড়ির মধ্যে টুল- টুল্ করিতেছে। রাজপুত্র মতির ঝালর হীরার ডাঁটে ভর দিয়া, অবাক হইয়া দেখিতে লাগিলেন।

দেখিতে দেখিতে, দেখিতে, দেখিতে, কত বচ্ছর চলিয়া গেল। রাজকন্যার আর ঘুম ভাঙ্গে না, রাজপুত্রের চক্ষে আর পলক পড়ে না।* রাজকন্যা অঘোরে ঘুমাইতেছেন, রাজপুত্র বিভোর হইয়া দেখিতেছেন।

হঠাৎ একদিন রাজপুত্র দেখেন, রাজকন্যার শিয়রে এক সোনার কাটি! রাজপুত্র আস্তে আস্তে সোনার কাটি তুলিয়া লইলেন।

সোনার কাটি তুলিয়া লইতেই দেখেন, আর এক দিকে এক রূপার কাটি। রাজপুত্র আশ্চর্য হইয়া রূপার কাটিও তুলিয়া লইলেন। দুই কাটি হাতে লইয়া রাজপুত্র নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতে লাগিলেন।

দেখিতে দেখিতে, সোনার কাটিটি কখন টুক করিয়া ঘুমন্ত রাজকন্যার মাথায় ছুঁইয়া গেল! অমনি পদ্মের বন শিউরে উঠিল, সোনার খাট নড়িয়া উঠিল, সোনার পাঁপড়ি ঝরিয়া পড়িল, রাজকন্যার হাত হইল, পা হইল; গায়ের আলস ভাঙ্গিয়া, চোখের পাতা কলাইয়া ঘুমন্ত রাজকন্যা চমকিয়া উঠিয়া বসিলেন।

আর অমনি রাজপুরীর চারিদিকে পাখী ডাকিয়া উঠিল, দুয়ারে দুয়ারী আসিয়া হাঁক ছাড়িল, উঠানে হাতী ঘোড়া ডাক ছাড়িল, সিপাই তরোয়াল ঝন্ ঝন্ করিয়া উঠিল; রাজদরবারে রাজা জাগিলেন, মন্ত্রী জাগিলেন, পাত্র জাগিলেন-হাজার বচ্ছরের ঘুম হইতে, যে যেখানে ছিলেন, জাগিয়া উঠিলেন- লোক লস্কর, সিপাই পাহারা, সৈন্য সামন্ত তীর- তরোয়াল লইয়া খাড়া হইল।

সকলে অবাক হইয়া গেলেন - রাজপুরীতে কে আসিল!

রাজপুত্র অবাক হইয়া গেলেন, রাজকন্যা অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন।

রাজা, মন্ত্রী জন-পরিজন সকলে আসিয়া দেখেন, রাজপুত্র রাজকন্যা মাথা নামাইলেন। রাজপুরীর চারদিকে ঢাক- ঢোল, শানাই নাকাড়া বাজিয়া উঠিল!

রাজা বলিলেন, "তুমি কোন্ দেশের ভাগ্যবান রাজার রাজপুত্র, আমাদিগে মরণ- ঘুমের হাত হইতে রক্ষা করিয়াছ!"

জন-পরিজনেরা বলিল, "আহা। আপনি কোন্ দেবতা-রাজার দেব রাজপুত্র-এক দৈত্য রূপার কাটি ছোঁয়াইয়া আমাদের গামা সোনার রাজ্য ঘুম পাড়াইয়া রাখিয়াছিল, আপনি আসিয়া আমাদিগে জাগাইয়া রক্ষা করিলেন।"

রাজপুত্র মাথা নোয়াইয়া চুপ করিয়া রহিলেন।

রাজা বলিলেন, "আমার কি আছে, কি দিব? এই রাজকন্যা তোমার হাতে দিলাম, এই রাজত্ব তোমাকে দিলাম।"

চারিদিকে ফুল-বৃষ্টি, চারিদিকে চন্দন বৃষ্টি; ফুল ফোটে, খৈ ছোটে, রাজপুরীর হাজার ঢোলে ডুম- ডুম কাটি পড়িল।

তখন, শতে শতে বাঁদী দাসী বাটনা বাটে, হাজারে হাজার দাই দাসী কুটনা কোটে;

দুয়ারে দুয়ারে মঙ্গল ঘড়া

পাঁচ পল্লব ফুলের তোড়া;

আল্পনা বিলিপনা, এয়োর ঝাঁক,

পাঠ- পিঁড়ী আসন ঘিরে', বেজে ওঠে শাঁখ।

সে কি শোভা! - রাজপুরীর চার- চত্বর দলদল্ ঝলমল্। আঙ্গিনায় আঙ্গিনায় হুলুধ্বনি, রাজভাণ্ডারে ছড়াছড়ি; জনজনতার হুড়াহুড়ি, এতদিনের ঘুমন্ত রাজপুরী দাপে কাঁপে, আনন্দে তোলপাড়।

তাহার পর, ফুটফুটে চাঁদের আলোয় আগুন- পুরুত সম্মুখে, গুয়াপান, রাজ- রাজত্ব যৌতুক দিয়া, রাজা পঞ্চরত্ন মুকুট পরাইয়া রাজপুত্রের সঙ্গে রাজকন্যার বিবাহ দিলেন। চারিদিকে জয়ধ্বনি উঠিল।

দেশভ্রমণে এক বছর, দু' বছর, বছরের পর কত বছর গেল, গিয়েছেন, রাজপুত্র আজও ফিরেন না। কাঁদিয়া কাঁদিয়া, মাথা খুঁড়িয়া রাণী বিছানা নিয়াছেন। ভাবিয়া ভাবিয়া, চোখের জল ফেলিতে ফেলিতে রাজা অন্ধ হইয়াছেন। রাজ্য অন্ধকার, রাজ্যে হাহাকার।

একদিন ভোর হইতে না হইতে রাজদুয়ারে ঢাক ঢোল বাজিয়া উঠিল, হাতী ঘোড়া সিপাই সান্ত্রীর হাঁকে দুয়ার কাঁপিয়া উঠিল!

    রাণী বলিলেন, "কি, কি?”

    রাজা বলিলেন, “কে, কে?”

রাজ্যের প্রজারা ছুটিয়া আসিল। রাজপুত্র-রাজকন্যা বিবাহ করিয়া লইয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন !!

কাঁপিতে কাঁপিতে রাজা আসিয়া রাজপুত্রকে বুকে লইলেন। পড়িতে-পড়িতে রাণী আসিয়া রাজকন্যাকে বরণ করিয়া নিলেন।

প্রজারা আনন্দধ্বনি করিয়া উঠিল।

রাজপুত্র রাজার চোখে সোনার কাটি ছোঁয়াইলেন, রাজার চোখ ভাল হইল। ছেলেকে পাইয়া, ছেলের বউ দেখিয়া রাণীর অসুখ সারিয়া গেল।

তখন, রাজপুত্র লইয়া, ঘুমন্ত পুরীর রাজকন্যা লইয়া, রাজা রাণী সুখে রাজত্ব করিতে লাগিলেন।

[ঠাকুরমার ঝুলি]

Post a Comment