রাজপুত্র ও তার চার বন্ধু । প্রথম পর্ব

নতুন শিক্ষনীয় গল্প

এক দেশে ছিল এক রাজা। তার সাত রাণী। তার মধ্যে ছেলেটি খুব দুষ্ট। রাজার ছেলে বড় রাণীর একটি পুত্র হয়েছে। রাজার ছেলে হয়ে পথে পথে ধুলো খেলা করে। রাজা এই সব ধুলো খেলা পছন্দ করেন না। রাজার ছোট রাণীও গর্ভবর্তী।

একদিন রাজা পথিমধ্যে তার ছেলেকে দেখলো যে ছেলে ধূলো খেলছে। রাজা বলল, "বাড়ীতে সাত রাণী আছে, তারা একটা ছেলেকে ঠিক রাখতে পারে না! বাড়ী ফিরে এই ছেলে আর সাত রানীকে কতল করব।" রাণীরা এই কথা শুনলো, আর ছেলেকে নিয়ে সাত রাণী বনের দিকে চলল। রাজধানীর কিছু দূরে আছে একটা ছোট বন। এই বনের কিছুদূরে আছে একটা বড় বন। ছয় রাণী ছেলেটি নিয়ে বড় বনে ঢুকল। আর ছোট রাণী হাঁটতে পারে না। সে হাঁপাতে হাঁপাতে ছোট বনে থাকল। ক্লান্ত হয়ে তার আর হাঁটার শক্তি রইল না।

বড় বনে ছিল এক বড় মিষ্টির দোকান। গামলায় গামলায় রসগোল্লা, পানতুয়া, দানাদার, মণ্ড। সাজানো আছে। কিন্তু লোক নাই। আলমারীর গায়ে লেখা আছে মিষ্টি ওজন করে নিয়ে এই এই দাম বাক্সে রাখুন। পাশে ইন্দারা আছে, জল খান। দূর পথ হেঁটে ছেলে ও ছয় রাণীর খুব ক্ষিদে পেয়েছে। তারা লিখন পড়ে মিষ্টি নিল। টাকাটা বাক্সে রেখে, মিষ্টি খেয়ে ইন্দারায় জল খেতে গেল। ইন্দারায় থাকে এক রাক্ষসী। মিষ্টির দোকান তারই। এটা তার টোপ। মিষ্টি খেয়ে যেই জল তুলতে ইন্দারায় বালতি ফেলেছে, অমনি রাক্ষসী এসে ছয় রাণী ও ছেলেকে মুখে করে নিয়ে খেয়ে ফেলল। হাড়গুলো ইন্দারার ভিতর পড়ে রইল।

এদিকে ছোট রাণী কিছুদিন পর এক পুত্র প্রসব করল। ছেলের চেহারা ভাল। ছেলে মায়ের দুধ খায় আর বনের ফল খায়। এইভাবে সে একটু বড় হলো। লেখাপড়া শেখে নাই। একদিন খাবার খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে বনের মধ্যে মিষ্টির দোকান দেখল। নিজে খুব খেল, আর মায়ের জন্য নিয়ে এলো। লেখাপড়া জানে না, তাই সে লেখা পড়লেও না, ইন্দারার সন্ধানও পেল না। রাক্ষসী রোজ মিষ্টি তৈরী করে রাখে, আর ছেলেটি খায়।

এই ভাবে বনের ফল আর মিষ্টি খেয়ে সে হলো এক বলবান যুবক। বুনো মোষ সবার সঙ্গে লড়াই করে। বনের মধ্যে বাঘ, সিংহ, তাকে দেখলে বনের পশুরা ভয়ে পালায়। বুনো মোষ আর গাইকে ধরে তাদের দুধ খায়। বনে এমনি করে তার দিন কাটে। একদিন পশুরাজ সিংহ তার সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে হেরে গেল।

কিছুদিন পর ছোট বনে জলাভাব দেখা দিল। রাজপুত্রের মায়ের খব পিপাসা লেগেছে। মিষ্টির দোকানে এসে সে জলের খোঁজ করল। খুঁজতে খুঁজতে সে ইন্দারার সন্ধান পেল। বালতি ইন্দারাব উপর কপিকল দিয়ে টাঙান ছিল। জল তোলার জন্য বালতি ইন্দারায় নামাল। আর রাক্ষসী সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলো। লড়াই বাঁধল বীরের সঙ্গে রাক্ষসীর। বীর রাক্ষসীকে মেরে টাঙিয়ে রাখল মিষ্টির দোকানের সামনে। তারপর দুই বনের মাঝে একটা পুকুরের সন্ধান পেল। সেখান হতে জল নিয়ে গিয়ে মাকে খাওয়াল। আর বলল, সব দিকে বেড়াতে যাবে, যাবে না শুধু ঐ দক্ষিণ দিকের বড় বনে।

দক্ষিণ দিকে মাকে যেতে বারণ করল, আর তার মা দক্ষিণ দিকে একদিন বেড়াতে গেল। গিয়ে দেখল দোকানের সামনে ঝুলছে এক রাক্ষসী। মেয়েটিকে দেখে রাক্ষসী বলল, ঐ ইন্দারা হতে জল তুলে আমায় বাঁচান। আমার দেহটায় ঠিক করে ঐ ইন্দারার জল ছিটিয়ে দিলেই আমি বেঁচে যাব। আমি তিন সত্যি করছি, তোমাকে বা তোমার ছেলেকে খাব না। মেয়ের মন, রাক্ষসীর কথায় নরম হলো। আর বীরের মা তাকে বাঁচিয়ে দিল। বীর কিন্তু এসব কিছু জানে না।

বীর বনে বনে বেড়ায় ফলমূল পশুপক্ষীর মাংস এনে খায় দায়, ভালো থাকে। ছেলেও বনে বনে শিকারে যায়, মাও রাক্ষসীর কাছে যায়। এমনি করে রাক্ষসীর সঙ্গে তার খুব ভাব হয়ে গেল। একদিন তার মা রাক্ষসীকে বলল, তুমি আমার ছেলেকে খেয়ে নাও, আমরা দুজন সুখে থাকি। ঐ ছেলে যখন সব জানতে পারবে তখন আমাদের শাস্তি দেবে। রাক্ষসী বলল, আমি তিন সত্য করেছি, এ সত্য আমরা ভাঙ্গি না। তোমাকে তোমার ছেলের ক্ষতি না করার কথা দিয়েছিলাম।

মা বলে, তাহলে উপায়? রাক্ষসী বলল, তুমি এক কাজ কর, তুমি আজ গিয়ে বিছানায় অসুখের ভান করে পড়ে থাক। ছেলে এসে শুধাবে, মা তোমার কি হয়েছে? তুমি বলবে, আমার কঠিন অসুখ করেছে, বাঘের দুধ খেলে এই অসুখ সারবে। ছেলে বাঘের দুধ আনতে গেলে তাকে বাঘে খেয়ে নেবে। তাই হলো। বীরের মা অসুখের ভান করে বিছানায় পড়ে থাকল। মাতৃভক্ত ছেলে শুধাল, মা তোমার কি হয়েছে? মা বলল, আমার কঠিন অসুখ করেছে, বাঘের দুধ খেলে বাঁচবো নচেৎ মরে যাব।

ছেলে তখন একটা পাত্র নিয়ে বনে গেল। বনের মাঝখানে একটা বাঘ কিছু দিন হলো বিয়েছে। তার তিন চারটি ছা। বীর গিয়ে তাকে ধরল। বাঘ বলল, অর্ধেকটা দুধ নাও, আর অর্ধেকটা রেখে দাও। আমার ছারা দুধ না পেলে কষ্ট পাবে। আর, তোমার মায়ের কোন অসুখ হয় নি। সে তোমাকে মারার জন্য পাঠিয়েছে। বীর বলল, খবরদার! আমার মা সম্বন্ধে যা তা বলবি না; এরপর বললেই মেরে ফেলব। বাঘ আর কি করে! চুপ করে গেল। ছেলে বাঘের দুধ এনে মাকে খাওয়াল।

পরদিন মা রাক্ষসীর নিকটে গিয়ে বলল, ছেলে তো বাঘের দুধ এনে দিল। এরপর কি করা যায়? রাক্ষসী বলল, এই বনের আরও দক্ষিণে আর একটা গহীন বন আছে! সেখানে এক বড় দালানে আমার বড় ভাই রাক্ষস বাস করে। সে বড় বীর, তার কাছে ওষুধ আনতে পাঠাও, সে তোমার ছেলেকে মেরে ফেলবে। 

রাক্ষসীর কথা শুনে তার মা আবার অসুখের ভান করে পড়ে রইল। ছেলে এসে শুধাল, মা কি হয়েছে? মা বলল, কঠিন অসুখ, বাবা! এই বনের অনেক দক্ষিণে আর একটা বড় বন আছে, সেই বনে থাকে এক বৃদ্ধ কবিরাজ, তার কাছ হতে ওষুধ আনলে আমি বাঁচব। বীর তার পরদিন সেখানে যাত্রা করল। বনের মধ্যে বাড়ীর সিংহদ্বারে রাক্ষস বসে থাকে, শিকার পেলেই ধরে। বহু বৎসর পর বনের দিকে মানুষ আসতে দেখে সে খুব খুশী হলো। ভাবল, যাক্ আজ মানুষের মাংস খেতে পাব।

বীর গিয়ে তার নিকট ওষুধ চাইল। সে বলল, ওষুধ কিসের? তোকে ধরে খাব। বীর তার চুল চেপে ধরে মারতে লাগল। মার খেয়ে রাক্ষস বুঝল, এ শিকার ঘায়েল করা যাবে না। বীরও ওষুধ ছাড়া যাবে না। কে আর মার খায়, সে বাড়ী গিয়ে এক শিশি পচান এনে দিল। বীর মনে করল এটাই ওষুধ। এনে মাকে দিল। 

কিছুতেই কিছু হলো না। মা আবার রাক্ষসীর সঙ্গে যুক্তি করতে বসল। রাক্ষসী বলল, এইবার এমন জায়গায় পাঠাব, সেখান হতে তোমার ছেলে আর ফিরবে না। তের নদী পারে আছে এক দীঘি, সেই দীঘির চারিদিকের জলে আগুন জ্বলছে, আর দীঘির মাঝখানের জল ঠাণ্ডা। এই জ্বালাপোড়া জল আনতে পাঠাও। এই পুকুরের জলে নামলেই তোমার ছেলে গরম জলে সিদ্ধ হয়ে মরে যাবে। পরদিন মা অসুখের ভান করে পড়ে রইল। ছেলে শুধাল কি হয়েছে? মা বলল, কঠিন অসুখ হয়েছে। তের নদী পারে দীঘি হতে জ্বালাপোড়া জল আনতে হবে। সেই জল খেলে অসুখ ভাল হবে।

বীর তার পরদিন তের নদী পার হয়ে আলাপোড়া জল আনতে গেল। দীঘির ধারে গিয়ে দেখে চারিদিকে জলের উপর আগুন জ্বলছে। সেখানে ছিল এক কুমারী যুবতী কন্যা। সে জ্যোতিষ গণনা জানতো। সে গণনা করে সব বুঝতে পারল। তারপর বীরকে তার বাড়ী নিয়ে গেল। বীরকে বলল, এ জল আনতে গেলেই তুমি মরে যাবে। বীর বলল, যে করেই হোক জল নিতেই হবে। কন্যা বলল, তাঁর হতে লাফ মেরে পুকুরের মধ্যস্থলে পড়তে হবে। তারপর ঘটিতে জল নিয়ে লাফ দিয়ে পাড়ে আসতে হবে। আগুনের উপরে পড়লেই তুমি মরে যাবে। আর পাড় হতে দড়ি বেঁধে ঘটি ডুবিয়ে জ্বালাজল তুলে নিতে হবে।

বীর সেই ভাবে জল সংগ্রহ করল। মেয়েটি খুব সুন্দরী। সে বলল, তুমি দুদিন এখানে থাক, বিশ্রাম কর। তোমার শত্রু তোমার মা। সে রাক্ষসীকে বাঁচিয়ে তার সঙ্গে সই পাতিয়ে তোমাকে মারতে চাইছে। প্রথমে বাঘের দুধ, তারপর গহীন বনে রাক্ষসের নিকট পাঠিয়ে ছিল। এই দুই স্থানে তোমার মৃত্যু হয় নি, তাই তোমাকে এই জ্বালাপোড়া জল আনতে পাঠিয়েছে। আচ্ছা, বাঘের দুধ যখন আনতে যাও, তখন বাঘ তোমাকে কোন কথা বলেনি! বীর বলল, হ্যাঁ বাঘ বলেছিল যে, তার মা তার শত্রু।

বীর বলল, তবে আমি এসব কথা বিশ্বাস করি না। কন্যা বলল, তুমি দেখতে চাও, না শুনতে চাও? বীর বলল, দেখতে চাই। কন্যার কাছে একটা উড়ন খাট ছিল। তার উপরে দুজনে চাপল, আর নিমিষে এসে সেই খাট ইন্দারার কাছে এলো। দেখল মা ও রাক্ষসী ইন্দারায় বসে আছে। বীরকে দেখে তার মা ও রাক্ষসী ভয় পেয়ে গেল। কন্যা বলল, ইন্দারা হতে সব হাড় তুলে আন, আমি সকলকে মন্ত্র বলে মানুষ করে দিব। এই ভাবে সব লোক বেঁচে গেল। আর তখন তার সাত মা ও বড় ভাইকে বাপের রাজ্যে পাঠিয়ে দিল। আর নিজে সেই কন্যাকে বিয়ে করে কন্যার দেশে চলে গেল। সঙ্গে গেল রাক্ষসি। বীর তার নাম দিল খাঁদি বাঁদী। এই কন্যার রাজ্যের নাম আকরম শহর। আর বীরের নাম দিল মকরম বাদশা।

প্রথম পর্ব সমাপ্ত


পরবর্তী পর্ব পড়ুন

Post a Comment